কুরআনের কথা

তোমাদেরকে ভালো এবং পবিত্র যা কিছু খেতে দিয়েছি, সেটা খাও — বাকারাহ ৫৭

বনি ইসরাইলের এক বিশাল কাফেলা নিয়ে নবী মুসা عليه السلام হেঁটে যাচ্ছেন এক বিশাল মরুভূমির মধ্য দিয়ে। যেদিকে চোখ যায় কোনো পানি বা খাবারের ব্যবস্থা নেই, তার উপর প্রচণ্ড রোদের তাপ। নারী, শিশু, বৃদ্ধ নিয়ে কাফেলার মানুষদের মৃত প্রায় অবস্থা। এমন সময় আল্লাহর تعالى আদেশে তাদের মাথার উপরে মেঘ জড়ো হয়ে, তাদের জন্য আরামদায়ক ছায়া তৈরি করল।[৬][১][৩]

আমি মেঘ দিয়ে তোমাদের জন্য আরামদায়ক ছায়ার ব্যবস্থা করেছিলাম, তোমাদেরকে উপর থেকে মান্না এবং সালওয়া পাঠিয়েছিলাম—“তোমাদেরকে ভালো এবং পবিত্র যা কিছু খেতে দিয়েছি, সেটা খাও।” আর ওরা আমার উপর কোনোই অন্যায় করেনি, বরং ওরা নিজেদের সাথেই অন্যায় করছিল। [বাকারাহ ৫৭]

আরবি গামাম (غمام) হচ্ছে ঘন মেঘ, কিন্তু সেটা ঝড়ের মেঘের মতো ভয়ংকর মেঘ নয়, বরং ছায়া দেয়, এমন ঘন প্রশান্তিকর, হাসিখুশি মেঘ।[১] মরুভুমিতে বনি ইসরাইলিদের কোনো বাড়িঘর ছিল না। এত গাছপালাও ছিল না যেখানে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। যদি আল্লাহ تعالى তাদের জন্য দিনের বেলা মেঘ দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা না করে দিতেন, তাহলে তারা হিট স্ট্রোক করে মারা যেত।[৩]

এরপর তাদের দরকার হলো কার্বোহাইড্রেট। আল্লাহ تعالى তাদের জন্য মান্‌ন পাঠিয়ে দিলেন, যা একধরনের মধুর মতো মিষ্টি খাবার ছিল এবং শিশিরের সাথে রাতের বেলা আকাশ থেকে পড়ে থাকত।[৪][৫][১][৬][১১] منن মান্‌ন শব্দটির অর্থ হচ্ছে ঊর্ধ্বতন কারও কাছ থেকে পাঠানো অনুগ্রহ বা উপহার। ভোর বেলা উঠে তারা মাটি থেকে মান্‌ন সংগ্রহ করত। রোদ কড়া হলে এটা নিজে থেকেই উবে যেত।[১][১১] আল্লাহ تعالى তাদেরকে এমন এক অসাধারণ খাবার পাঠালেন, যেটা তাদেরকে কষ্ট করে চাষ করতে হতো না, মাঠ থেকে তুলে এনে রান্না করেও খেতে হতো না, এমনকি খাওয়ার পর পরিত্যক্ত খাবার ডাস্টবিনে গিয়েও ফেলতে হতো না, নিজেই উবে যেত। মরুভূমিটা তাদের জন্য ব্যুফে সার্ভিস হয়ে গিয়েছিল। হেঁটে হেঁটে থালায় করে ইচ্ছেমত মান্‌ন সংগ্রহ করে, আরামে বসে খাওয়া, আর গল্প করা ছাড়া তাদের আর কোনো কষ্টই করতে হতো না।

বেশিদিন মান্‌ন খেয়ে তাদের মন ভরল না। এরপর তাদের দরকার হলো প্রোটিনের। আল্লাহ تعالى তখন তাদেরকে সালওয়া নামের একধরনের পাখি পাঠিয়ে দিলেন। এই পাখিগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে এসে তাদের সামনে মাটিতে বসে থাকত, ধরতে গেলেও পালিয়ে যেত না।[১২][১] একেবারে বিনামূল্য মাংসের হোম ডেলিভারি! একটু কষ্ট করে আগুনে ঝলসিয়ে খেলেই হলো।

আল্লাহ تعالى বনি ইসরাইলিদের কয়েক লাখ জনসংখ্যার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে দিলেন। তারা চল্লিশ বছর ধরে এই মান্‌ন এবং সালওয়া খেয়েই ছিল। এই সময়টাতে তাদের কখনও দুর্ভিক্ষ হয়নি, কোনো মহামারী হয়নি।[৩]

বনি ইসরাইলিদের উপর এরকম ভিআইপি খাতিরের ঘটনা পড়ে, অনেক সময় মুসলিমরা অভিযোগ করেন, “আল্লাহ তো ওই দুষ্ট বনি ইসরাইলগুলোকে কতই না আরামের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাদের জন্য আকাশ থেকে মান্না এবং সালওয়া আসতো। কিন্তু আজকে যে আফ্রিকাতে হাজার হাজার গরিব মুসলিমরা, সিরিয়াতে ছোট শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে, বাংলাদেশে গরিব মানুষরা খাবারের অভাবে হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছে—এদের জন্য আল্লাহ মান্না এবং সালওয়া পাঠান না কেন?”

আফ্রিকা, বসনিয়া, মায়ানমার, বাংলাদেশ সহ যত গরিব দেশ আছে, আজকে সব দেশেই আল্লাহ تعالى মান্‌ন এবং সালওয়া পাঠাচ্ছেন। ইসলামিক রিলিফ, মুসলিম এইড, সেভ দ্যা চিলড্রেন সহ অনেকগুলো সংগঠন আকাশ থেকে প্লেনে, হেলিকপ্টারে করে ত্রাণ সামগ্রি নিয়ে গিয়ে সেই দেশগুলোতে ফেলছে। যেসব দেশে আকাশ থেকে খাবার ফেলা যাচ্ছে না, সেই সব দেশে আল্লাহ تعالى পানি থেকে মান্‌ন এবং সালওয়া উঠে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন: উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে জাহাজে, নৌকায় করে বিভিন্ন সংগঠন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসছে। খাবার, পানি, কাপড়, ওষুধ, চিকিৎসা সবকিছুই সেই দেশগুলোর অভাবী মানুষদের কাছে গিয়ে, নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা দিয়ে আসছে, এমনকি অনেকে মারাও যাচ্ছেন এই সেবা করতে গিয়ে। আল্লাহ تعالى ঠিকই সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ হতভাগা মানুষের যত্ন নিচ্ছেন, শুধু যত্ন নেওয়ার পদ্ধতিটা পাল্টে গেছে।

এই আর্টিকেলটি লেখার সময় পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে সিরিয়াতে ৩৭৩ মিলিয়ন ডলার মান্‌ন (দান) গিয়েছে।[৩০৬] সিরিয়াতে এক আন্তর্জাতিক SHARP আপিলের মাধ্যমেই আল্লাহ تعالى প্রায় ৫০৪ মিলিয়ন ডলার, যা প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকার মতো মান্‌ন পাঠিয়েছেন।[১০] এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গিয়েছে ১৭৫ মিলিয়ন ডলার এবং দ্বিতীয় অবস্থানে যুক্তরাজ্য থেকে গিয়েছে ৮৭ মিলিয়ন ডলার।[১০] পশ্চিমা দেশগুলোর মুসলিম এবং অমুসলিম উভয় জনগোষ্ঠী থেকে আমাদের মুসলিম ভাইদের বিপদের দিনে বিপুল পরিমাণে সাহায্য যাচ্ছে।

আল্লাহ تعالى আজকে পৃথিবীতে অনেক মানুষকে সুযোগ দিয়েছেন হতভাগ্য মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর, তাদেরকে মান্‌ন এবং সালওয়া পৌঁছে দেওয়ার। প্রশ্ন হচ্ছে: আমরা কি সেই সুযোগটা নিয়ে নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুনে পোড়া থেকে বাঁচাচ্ছি, নাকি বসে বসে ভাবছি, “অন্যেরা তো করছেই, আমি একা না করলে আর কী বা যায় আসে?”

এই আয়াতে: “তোমাদেরকে ভালো এবং পবিত্র যা কিছু খেতে দিয়েছি, সেটা খাও”—এটি শুধু বনি ইসরাইলিদের জন্যই নয়, বরং সকল যুগের, সকল মানুষের, সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম—সবার জন্য নির্দেশ। তাইয়িব طيب হচ্ছে যা ভালো এবং পবিত্র— দুটোই একসাথে।[১] আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যা দেন, সেটা আমাদের জন্য ভালো এবং পবিত্র। কিন্তু মানুষ অনেক সময় অনেক কিছু তৈরি করে যেটা খেতে ভালো হলেও, পবিত্র নয়। যেমন, আল্লাহ تعالى কলা দিয়েছেন, যা তাইয়িব— ভালো এবং পবিত্র। কিন্তু মানুষ যখন এই কলাকে পোকা মারার বিষ ডিডিটি এবং ভারত থেকে আনা কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে বিক্রি করে[৩১১], তখন সেটা খাওয়ার যোগ্য হলেও, সেটা আর পবিত্র থাকে না, তাইয়িব-এর দুটি শর্ত পূরণ করে না। সুতরাং এই ধরনের কলা, ফরমালিন দিয়ে রাখা ফল, মাছ খাওয়া যাবে না।

আর ব্যবসায়ী ফার্মগুলোর জঘন্য পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা অসুস্থ হাঁসমুরগি, গরুছাগল, যেগুলোর সাথে চরম দুর্ব্যবহার করা হয়, এন্টিবায়োটিক এবং হরমোন ইনজেকশন দিয়ে মোটা থলথলে বানানো হয় – সেগুলোও খাওয়া যাবে না, কারণ এগুলো তাইয়িব থাকে না। এমনকি মুসলিম বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, এগুলো হালাল থাকারও সম্ভাবনা কম, কারণ হালাল হতে হলে প্রাণীদের উপর এধরনের অন্যায় করা যাবে না, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম এভাবে ভাঙ্গা যাবে না।[৩০৫] এই ধরনের অপবিত্র খাবার খেলে আমরা কু’রআনের এই কঠিন নির্দেশটির অবাধ্য হবো। কু’রআনে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে শুধু হালাল খাবার খেতেই বলেননি, তিনি সমগ্র মানবজাতিকে: মুসলিম-অমুসলিম উভয়কেই তাইয়িব (ভালো এবং পবিত্র) খাবার খেতে বলেছেন।

আয়াতটির শেষটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ: “আর ওরা আমার উপর কোনোই অন্যায় করেনি, বরং ওরা নিজেদের সাথেই অন্যায় করছিল”। আল্লাহর تعالى নির্দেশ অমান্য করে আমরা আল্লাহর تعالى কোনো ক্ষতি করি না, বরং নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারি। কেউ যখন বন্ধু-বান্ধবের সাথে পার্টি করে হুইস্কি খায়, সে আল্লাহর تعالى কোনো ক্ষতি করে না, নিজের লিভারে নিজেই ‘কুড়াল’ মারে।[৩০৭] কেউ যখন মরা মুরগি দিয়ে বানানো চিকেন ব্রোস্ট খায়, বা দোকানের ভেজাল তেল, মেয়াদ উত্তীর্ণ ডালে রান্না করা মরা গরুর মাংসের হালিম খায়, তখন সে আল্লাহর تعالى কোনো ক্ষতি করে না, বরং সে নিজের পরিপাকতন্ত্রে নিজেই ‘কুড়াল’ মারে, একসময় জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে, মাসের পর মাস হাসপাতালে পড়ে থেকে, ধুকে ধুকে মারা যায়।[৩০৮] কেউ যখন অল্প কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য দেশি বা অরগানিক প্রাণীর মাংস না খেয়ে ফার্মের অসুস্থ, বিকৃত প্রাণীর মাংস খায় (Meet your meat), সে তখন নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের শরীরে ‘কুড়াল’ মারে, ভবিষ্যতে পরিবারের চিকিৎসার খরচ দিতে গিয়ে দিনরাত খেটে মরে।[৩০৯] কেউ যখন হারাম সুদের ঋণ নিয়ে বাড়ি কেনে, তখন সে আল্লাহর تعالى কোনো ক্ষতি করে না, বরং নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ এবং দেশের অর্থনীতিতে ‘কুড়াল’ মারে: লোণ শোধ করার দুশ্চিন্তায় ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস, মানসিক অশান্তি বাড়ায়। লোণ শোধের জন্য বাড়তি কাজ করতে গিয়ে ছেলেমেয়েদেরকে ঠিকমতো সময় না দিয়ে, তাদেরকে উচ্ছন্নে যেতে দেয়। তারপর যখন গুরুতর অসুস্থ হয় বা মারা যায়, তখন পরিবারের উপরে একটা লোণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে চলে যায়।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যা কিছুই করতে মানা করেছেন, প্রত্যেকটির পিছনে কোনো না কোনো কারণ রয়েছে। আমরা অনেক সময় যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করে দেখি না সেই কারণগুলো কী। আমরা অনেকে মনে করি, “আমার যেখানে লাভ হচ্ছে, সেখানে এটা মানা করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? আল্লাহ تعالى কেন খামোখা কোনো কিছু হারাম করে দিবেন, যাতে আমার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না?” প্রথমত, আমরা যথেষ্ট গবেষণা করে দেখি না যে, আমরা যা করছি বা যা খাচ্ছি, তাতে সত্যিই আমার কোনো সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হচ্ছে কিনা, পরিবারের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কিনা, সমাজের এবং দেশের অবস্থার অবনতি ঘটছে কিনা। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর পরিমাণে গবেষণা হয়েছে অ্যালকোহল, সুদ, জুয়া, ফার্মের হাঁসমুরগি, কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গবাদি পশু, জেনেটিক উপায়ে পরিবর্তন করা শাকসবজি-ফলমূল, সঠিক ভাবে জবাই না করা পশুর মাংস, হিন্দি সিরিয়াল দেখা, পর্ণ দেখা, ব্যভিচার করা, মেয়েদের স্বল্প কাপড় পড়া[৩১০] ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট ভয়ংকর সব শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির উপরে। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন ইত্যাদি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করা শত শত সোশিয়লজি (sociology), সাইকোলজি এবং অর্থনীতিবিদ্যার গবেষণা পত্র রয়েছে, যেগুলো পড়লে মনে হবে সেগুলো কু’রআনের আয়াতগুলোরই তাফসীর। সেই গবেষণাপত্রগুলো পড়লে দেখবেন: তারা আল্লাহর تعالى সাবধান বাণীগুলোকেই বৈজ্ঞানিক যুক্তি, প্রমাণ এবং পরিসংখ্যান দিয়ে আবারও প্রমাণ করছে — যেগুলো আমরা ১৪০০ বছর আগেই পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই বাণীগুলোর মর্ম বুঝিনি। প্রথমত, আমরা এইসব গবেষণা পত্রগুলোর খবর রাখি না। দ্বিতীয়ত, পেলেও মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখি না, বা পড়লেও নিজেকে পরিবর্তন করি না। আমাদের উদ্দেশ্য থাকে: যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের চাহিদা-কামনা-বাসনা মিটিয়ে ফেলা। কার কী ক্ষতি হলো তাতে আমার কী যায় আসে?

সুত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version