সূরা বাকারাহ ৪ নম্বর আয়াতটি নিয়ে আধুনিক মুসলিমদের মধ্যে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছে—
যারা তোমার (মুহাম্মাদ) উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার আগে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস করে, যারা পরকালে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে।[বাকারাহ-৪]
প্রশ্ন আসে, কেন আমাদেরকে কু’রআনের পাশাপাশি আগে যে কিতাবগুলো নাজিল হয়েছিল সেগুলোতে বিশ্বাস করতে হবে? −এর মানে কি আমাদের তাওরাত, জাবুর, ইনজিল এগুলো সব পড়তে হবে? আমাদের কি ইহুদিদের মতো তাওরাতে যা আছে সেটা মানতে হবে? খ্রিষ্টানদের মতো গস্পেলে যা আছে সেগুলো মানতে হবে? আজকে যারা ইহুদি এবং খ্রিষ্টান, তারা কি তাহলে আল্লাহর تعالى দেওয়া ধর্মের উপর আছে এবং তাদের কি কু’রআন মানার কোনো প্রয়োজন নেই? তারা কি মুসলিমদের মতোই জান্নাতে চলে যাবে?
কেন আল্লাহ تعالى একবারে মানুষকে কু’রআন না দিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ দিলেন? একবারে আদম (আ) কে কু’রআন দিয়ে পাঠালে কি সব ঝামেলা শেষ হয়ে যেত না? আমরা কি তাহলে সবাই এক ধর্মের অনুসারী হয়ে মারামারি বন্ধ করে শান্তিতে থাকতে পারতাম না?
প্রথমে একটা মজার ব্যাপার বলে নেই। দেখুন এখানে বলা আছে, “যারা বিশ্বাস করে তাতে, যা তোমার উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা তোমার আগে অবতীর্ণ হয়েছে।” এখানে কোথাও বলা নেই: “যা তোমার পরে অবতীর্ণ হবে” বা “যা তোমার পাশাপাশি আরেকজনের উপর অবতীর্ণ হবে।” এর মানে দাঁড়ায়: যে সব আহমাদিয়া/কাদিয়ানী অনুসারীরা মনে করে তাদের ‘নবী’র কাছে আল্লাহ تعالى নতুন বাণী পাঠিয়েছিলেন, তাদের সব যুক্তি সূরা বাকারার শুরুতেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এমনকি যেসব চরম শিয়া অনুসারীরা মনে করে আলি(রা)−এর নবী হওয়ার কথা ছিল; ফেরেশতা জিবরাঈল ভুল করে মুহাম্মাদ عليه السلام-কে কু’রআন দিয়ে এসেছিল — তাদের এইসব ভ্রান্ত যুক্তিও এখানে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সূরা বাকারার ২, ৩, ৪−মাত্র এই তিনটি আয়াতে মহান আল্লাহ تعالى একদম নাস্তিকতা থেকে শুরু করে ইসলামের যতগুলো বিকৃত গোত্র রয়েছে, তাদের সবার খেল খতম করে দিয়েছেন! −এরকম আরও অনেক আয়াত রয়েছে কু’রআনে যেখানে আল্লাহ تعالى পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে, নবী মুহাম্মাদ عليه السلام−এর পরে আর কোনো রাসুল আসবে না, কোনো বাণী পাঠানো হবে না। দেখুন ১৬:৪৩, ৪০:৭৮, ২০:৪৭, ৪:৬০, ৩৯:৬৫, ৪২:৩, ২:১৮৩, ১৭:৭৭।
আপনার আহমাদিয়া/কাদিয়ানী, শিয়া বন্ধুদেরকে বলুন কু’রআনের এই আয়াতগুলো ভালো করে বারবার পড়তে। −এরপর আর তাদের কোনোই সন্দেহ থাকার কথা নয়—إن شاء الله। একই সাথে আপনার গুরু পূজারী সূফী বন্ধুদেরকেও বলুন যে, তাদের গুরু এবং পিরের কাছে আল্লাহ تعالى যে ঐশী বাণী পাঠান না, সেটা কু’রআনে পরিষ্কার করে বলা আছে। কু’রআন মুত্তাকীদের জন্য একটি সম্পূর্ণ পথ নির্দেশ। −এর পরে আমাদের আর কোনো ঐশী বাণীর দরকার নেই।[১০৬]
আমাদের সঠিক ধারণা থাকা দরকার তাওরাত এবং ইনজিল কী। তাওরাত হচ্ছে ছয়টি হিব্রু বাইবেল, যেগুলোর ইংরেজি সংস্করণ হচ্ছে: Genesis, Exodus, Leviticus, Numbers, Deuteronomy. এগুলো ইহুদিদের মূল ধর্মগ্রন্থ। এরকম অনেকগুলো বইকে একসাথে The Old Testament বলা হয়।
ইনজিল Gospel নামে পরিচিত – Matthew, Mark, Luke, and John। এগুলো মূলত খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ। এগুলোর ব্যাপারে মুসলিমদের অবস্থান হলো: ঈসা عليه السلام -কে যে ইনজিল দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো হারিয়ে গেছে এবং গস্পেল বলতে যা এখন মানুষের কাছে আছে সেগুলো সব মানুষের লেখা, যার মধ্যে কিছুটা হলেও আল্লাহর বাণী রয়েছে। এমনকি এটা আজকাল খ্রিষ্টানদেরও অবস্থান যে, ইঞ্জিলের আসল গ্রন্থগুলো হারিয়ে গেছে।
আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, কু’রআনই আল্লাহর تعالى পাঠানো একমাত্র ঐশীবাণী নয়। আল্লাহ تعالى মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য -এর আগেও বাণী পাঠিয়েছেন। নবী মুসা عليه السلام -এর কাছে তাওরাত এসেছিল, নবী ঈসা عليه السلام -এর কাছে ইনজিল এসেছিল। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ تعالى আমাদের আগেও মানুষকে পথ দেখিয়েছেন বিভিন্ন নবী এবং বাণীর মাধ্যমে। একদম প্রথম মানুষ আদম عليه السلام থেকে শুরু করে আজকে আমাদের সভ্যতা পর্যন্ত সব জাতি আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পথ নির্দেশ পেয়েছে।
এই বিশ্বাসের মধ্যে দুটো ব্যাপার রয়েছে—
১) প্রথমত, এটা মানা যে: আজকে যে তাওরাত এবং ইঞ্জিল বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে কিছুটা হলেও আল্লাহর تعالى বাণী রয়েছে এবং আমাদেরকে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। আমেরিকার কোনো এক পাদ্রী তার দলবল নিয়ে প্রতি বছর কু’রআন পোড়ায় দেখে[১১৭], আমরাও তার মতো বাইবেল পুড়িয়ে দেখিয়ে দেব না যে, আমরাও মুসলিমের বাচ্চা। আমরা সকল ধর্মের বইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রাখি। খ্রিষ্টানরা কু’রআন পুড়িয়ে নিচে নামতে পারে, কিন্তু তাই বলে আমরা বাইবেল পুড়িয়ে তাদের মতো নিচে নামব না।
২) আমাদেরকে এটা সবসময় মনে রাখতে হবে যে, ইহুদি এবং খ্রিষ্টানরা যা-ই করছে সেটাই ভুল না। তাদের বিশ্বাস ভুল হতে পারে, তারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস না করতে পারেন, বা মুহাম্মাদকে عليه السلام রাসূল হিসেবে বিশ্বাস না করতে পারেন। তবে তাদের পার্থিব সকল কাজই ভুল নয়। তাই আমরা তাদের প্রতি কোনো ঘৃণা দেখাব না। মনে করব না যে, তারা সব ভুল পথে আছে এবং তারা যা করে, তার কোনো কিছুই ঠিক নয়। আমরা মুসলিম। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান জাতি। পৃথিবীতে আরও ৫০০ কোটি মানুষ আছে যাদেরকে আল্লাহ تعالى ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার সৌভাগ্য দেননি। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের খ্রিষ্টান এবং ইহুদি ভাই বোনেরা কিছু প্রতারকের পাল্লায় পড়ে ভুল রাস্তায় চলে গেছে। আমাদের দায়িত্ব তাদেরকে ডাক দিয়ে এনে, ভালো করে বুঝিয়ে শুনিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসা। ভালো করে বোঝানোর পরেও তারা যদি না আসে, তাহলে সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা কোনোভাবেই তাদের উপর জবরদস্তি করতে পারব না। আল্লাহই তাদের বিচার করবেন।
একই সাথে আমাদেরকে এটাও মনে রাখতে হবে যে, রাসূল মুহাম্মাদ عليه السلام -এর জন্মের অনেক আগে থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে তাওরাত এবং ইঞ্জিল পাওয়া যায়, সেগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন এবং বিকৃতি করা হয়েছে, যার কারণে সেগুলো আর মৌলিক, অবিকৃত অবস্থায় থাকেনি। সেগুলোর ব্যাপারে আমরা কেবল মৌলিকভাবে ঐশী গ্রন্থ হওয়ার বিশ্বাস করব, তবে সেগুলো পড়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছান যাবে না।
অধুনা কিছু মুসলিম আছেন, যারা শখের বসে তাওরাত বা ইঞ্জিল কিনে পড়েছেন। কিন্তু তারপরে তাদের মাথা গেছে একদম তালগোল পাকিয়ে। তারা কোনটা ইসলাম, কোনটা ইহুদি, কোনটা খ্রিষ্টান ধর্ম—সেসব নিয়ে গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। যেমন: কু’রআন, তাওরাত এবং ইঞ্জিলে আপনি নবী ইব্রাহিম عليه السلام -এর তিন ধরনের জীবনী পাবেন। আপনি যদি তিনটাই পড়েন, তাহলে তার সম্পর্কে আপনার ধারণা একেবারে গোলমাল পাকিয়ে যাবে। আপনি মনে করা শুরু করবেন যে, তিনি হয়তো ইহুদি ছিলেন। তিনি হয়তো একসময় মূর্তিপূজারি ছিলেন এবং পরে আল্লাহ তাকে পথ দেখিয়েছিলেন।[১] আজকাল অনেক আধুনিক মুসলিম তাওরাত, ইঞ্জিল পড়ে দাবি করা শুরু করেছে যে, আজকের মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিষ্টানরা সবাই আসলে এক নবী ইব্রাহিম-এর عليه السلام উম্মত এবং আমরা তার ধর্মের উপরেই আছি। সুতরাং খ্রিষ্টান এবং ইহুদিরা কেউই ভুল পথে নেই, তারা সবাই জান্নাতে চলে যাবে। সুতরাং, তাদের কারো ধর্ম পরিবর্তন করার কোনোই দরকার নেই।
এধরনের মানুষরা আগেও অনেক ছিল, এখনো অনেক আছে। তাদের জন্য আল্লাহর تعالى জবাব:
তারা বলে, “তোমরা ইহুদি বা খ্রিষ্টান হয়ে যাও, সঠিক পথ পাবে”, বল (মুহাম্মাদ), “কখনোই না! আমরা ইব্রাহিমের ধর্ম অনুসরণ করি। এটাই সঠিক। সে কখনই মুশরিক (বহুঈশ্বরবাদী, মূর্তিপূজারি) ছিল না।” [২:১৩৫]
ইহুদিরা নিঃসঙ্কোচে দাবি করে যে, তাদের তাওরাতে কোনো বিকৃতি নেই এবং তা হুবহু আল্লাহর تعالى বাণী। আজকাল অনেক মুসলিমও ইহুদীদের বিভিন্ন দলিল এবং যুক্তি দেখে মনে করা শুরু করেছে: “সত্যিই তো! তাওরাত দেখি সত্যিই আল্লাহর تعالى বাণী! তাহলে তো আমাদেরও তাওরাত পড়া উচিত। আর আমার খ্রিষ্টান গার্ল ফ্রেন্ডদেরকে বিয়ে করলে কোনো সমস্যা নেই। তারাও তো আল্লাহর تعالى ধর্মের উপরই আছে।”
এ ধরনের মানুষরা কখনো কু’রআন ঠিকমতো বুঝে পড়েনি:
তোমরা (বিশ্বাসীরা) কি আশা করো যে ওরা-১ তোমাদেরকে বিশ্বাস করবে যখন ওদের-১ মধ্যে একদল-২ আল্লাহর বাণী শুনত এবং তারপর তা বোঝার পর তারা-২ তা জেনে বুঝেই বিকৃত করত, যখন ওরা-১ তা ঠিকই জানত? [২:৭৫]
এমনকি তারা তাওরাত এবং ইঞ্জিলগুলোও (গস্পেল) আসলে ঠিকমত পড়েনি। পড়লে দেখত যে আজকের বিকৃত তাওরাতে কীভাবে আল্লাহ تعالى এবং নবীদের عليه السلام নামে জঘন্য মিথ্যা কথা প্রচার করা হচ্ছে:
১) ইয়াকুব (Jacob) আল্লাহর تعالى সাথে কুস্তি করে জিতে গিয়েছিলেন! তারপর তাকে নাকি নতুন নাম ‘ইসরাইল’ দেওয়া হয়েছিলঃ
Your name will no longer be Jacob,” the man told him. “From now on you will be called Israel, because you have fought with God and with men and have won..” [১১৯]
২) আল্লাহ تعالى নাকি মানুষকে সৃষ্টি করে অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর অন্তরে নাকি গভীর বেদনা হয়েছিল!
The LORD regretted that he had made human beings on the earth, and his heart was deeply troubled. [১২০]
৩) লুত নবী নাকি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন এবং তার মেয়েদের সাথে … তিনি নাকি তার নাতিদের পিতা ছিলেন!
…And it came to pass on the morrow, that the firstborn said to the younger, Behold, I lay last night with my father: let us make him drink wine this night also; and go you in, and lie with him, that we may preserve seed of our father. 35 And they made their father drink wine that night also: and the younger arose, and lay with him; and he perceived not when she lay down, nor when she arose. 36 Thus were both the daughters of Lot with child by their father. … [১২১]
—এরকম একটি, দুটি নয়, শত শত জঘন্য, অশ্লীল ঘটনায় ভরা বিকৃত তাওরাত আজ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, যা আমরা সাধারণত বাইবেল বলে জানি। প্রথমত, এগুলো নবীদেরকে عليه السلام বিকৃত মানসিকতা এবং কামনা-বাসনার কালিমা দিয়ে, তাদেরকে একদম নিচে নামিয়ে দিয়েছে, যেখানে কি না মহান আল্লাহ تعالى পৃথিবীতে সবচেয়ে যোগ্য, পবিত্র মানুষদেরকেই নবী হিসেবে মনোনীত করতেন।
দ্বিতীয়ত, এই বাইবেলগুলো মহান আল্লাহকে تعالى এতটাই নিচে নামিয়েছে যে, তিনি এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আর খুব একটা পার্থক্য বাকি রাখেনি। আজকাল পশ্চিমা চলচ্চিত্রে ‘গডকে’ মেঘের উপরে সাদা দাঁড়িওলা, আলখাল্লা পরা, মধ্যবয়স্ক এক বিশাল মানুষের আকৃতিতে দেখানো হয়। দেখানো হয় যে, তিনি স্বর্গে গিয়ে মানুষের সাথে কথা বলছেন, হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এগুলো সবই বাইবেলের (তাওরাতের) বিকৃত ধারণা থেকে এসেছে। এগুলো দেখতে দেখতে আমাদের মনের ভেতরে ব্যাপকভাবে শির্কের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
আমরা মুসলিমরা কোনোভাবেই আল্লাহকে নিয়ে কখনোই এভাবে চিন্তা করি না। আল্লাহ تعالى কে?—তার এক অসাধারণ সংজ্ঞা সূরা ইখলাসে দেওয়া আছে, পড়ে দেখুন। এটা পড়লেই আপনি বুঝতে পারবেন ইসলামে আল্লাহর تعالى ধারণা কতখানি পবিত্র এবং যুক্তিযুক্ত।
একইভাবে তাওরাত এবং ইঞ্জিলে, যা আজকাল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর কিছু নির্দেশ দেখলেই পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, সেটা কোনোভাবেই আল্লাহর تعالى বাণী হতে পারে না।
“Kill every male child and baby and kill every woman who is not a virgin. But save for yourself the virgin girls.” (Numbers 31:17-18)”
When…God gives (a city) into your hands, kill all the men in it…Do not leave alive anything that breathes.” (Deuteronomy 20:10-17)”
As for my enemies who do not want me (Jesus) to reign over them, bring them here and kill them in my presence.” (Luke 19:26-27)”
Do not think I (Jesus) have come to send peace on earth. I did not come to send peace, but a sword.” (Matthew 10:34)
ইহুদি এবং খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে এইসব ভয়াবহ কথা লেখা থাকার পর তারাই আবার ইসলাম ধর্মকে বর্বর, মধ্যযুগীয়, আগ্রাসী ধর্ম বলে দাবি করে এবং আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদকে عليه السلام ক্ষমতালোভী, বর্বর, পাষণ্ড মানুষ হিসেবে কালিমা দেওয়ার চেষ্টা করে! আরও বড় লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে তাদের আক্রমণ শুনে মুসলিমরাই আমতা আমতা করে পালিয়ে যায়। কু’রআনের শান্তির বাণীকে ঠিকভাবে তুলে ধরে তাদেরকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে পারে না। আল্লাহ تعالى যেখানে কু’রআনে বলেন:
“ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই”—কু’রআন ২:২৫৬
“আর শুধু তাদের সাথে লড়াই করো, যারা তোমাদের সাথে লড়াই করে, কিন্তু সীমা অতিক্রম করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”— কু’রআন ২:১৯০
“যদি তারা শান্তি চুক্তি করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে, তবে তুমিও (মুহাম্মাদ) তা করতে ইচ্ছা প্রকাশ করবে এবং আল্লাহর উপরে ভরসা রাখো।”—কু’রআন ৮:৬১
যিনি এক ধর্মগ্রন্থে—এরকম শান্তিপ্রিয় কথা বলেন, তিনি কীভাবে তাঁরই পাঠানো আরেকটি ধর্মগ্রন্থে শিশুদের হত্যা করার নির্দেশ, বিবাহিত মেয়েদেরকে মেরে ফেলে শুধু কুমারী মেয়েদেরকেই বাঁচিয়ে রাখার মতো জঘন্য নির্দেশ দিতে পারেন? সৃষ্টিকর্তা মানুষের মতো নন যে, যখন তার মাথা গরম থাকে, তখন তিনি খুনাখুনির নির্দেশ দেন, এবং পরে একসময় তার মাথা ঠাণ্ডা হলে, তিনি শান্তিপ্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। একজন সৃষ্টিকর্তার বাণীর মধ্যে কখনোই অসঙ্গতি থাকতে পারে না, সেটা হাজার বছরের ব্যবধানে অবতীর্ণ হলেও। যদি থাকে, তাহলে সেটা আর সৃষ্টিকর্তার বাণী নয়, বরং সেটা মানুষের রচনা।
পুরুষদের মাথায় যত নোংরা ফ্যান্টাসি আছে, তার সব আপনি বাইবেলে পাবেন, কিছুই বাকি নেই। বাইবেলের গ্রন্থগুলো পুরো মাত্রায় পর্ণগ্রাফি। আপনি কখনই বাইবেলের বইগুলো আপনার ছোট বাচ্চাদের সাথে বা কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে একসাথে বসে পড়তে পারবেন না।
অথচ কু’রআন পড়ে দেখুন। পুরো কু’রআনে কোনো জায়গায়, কোনো ধরনের গোপন অঙ্গের কথা, নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গতার সরাসরি বর্ণনা খুঁজে পাবেন না। আল্লাহ تعالى অত্যন্ত মার্জিত শব্দ ব্যবহার করে, সর্বোচ্চ শালীনতা বজায় রেখে আমাদের যৌনতা সম্পর্কে ইসলামের বিধিনিষেধগুলো শিখিয়েছেন। একজন আরব কিশোর-কিশোরীর কখনোই কু’রআন পড়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। একজন আরব বাবা-মা রমজানের তারাবীতে তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে সাথে নিয়ে গিয়ে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পুরো কু’রআন খতম শুনে আসতে পারেন, কিন্তু কখনোই কোনো লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়েন না।
মুসলিমরা কখনোই বিশ্বাস করে না যে, আজকের ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থে যে বাণী পাওয়া যায়, তা অবিকৃতভাবে আল্লাহর বাণী। কু’রআনের ভাষা এবং আজকালকার তাওরাত, ইঞ্জিলের ভাষার মধ্যে এতই আকাশ পাতাল পার্থক্য যে, সেগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে, প্রচলিত এই তিন ধর্মগ্রন্থের উৎস একই সত্তা নন।
এখন প্রশ্ন আসে, কেন আল্লাহ্ تعالى আদমকে عليه السلام একবারে কু’রআন দিয়ে পাঠালেন না? প্রথমে কু’রআন দিয়ে পাঠালেই তো এত ধর্ম তৈরি হতো না? বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে এত মারামারি হতো না?
আল্লাহ تعالى মানুষকে পথ নির্দেশ তখনি দেন, যখন সেই পথ নির্দেশের প্রয়োজন মানুষের হয় এবং মানুষের তা বুঝে বাস্তবায়ন করার মতো অবস্থা থাকে। যেমন, আদমকে عليه السلام যে ধর্মীয় নিয়মকানুন দেওয়া হয়েছিল, সেই নিয়ম অনুসারে ভাইবোন বিয়ে করতে পারত। যদি তাকে আজকের কু’রআন দেয়া হতো, তাহলে আদম عليه السلام-এর ছেলেমেয়েদের পর আর কোনো বংশধর আসত না। মানব জাতি এক প্রজন্মের পরেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।[১০৫] একই ভাবে তাওরাতের আগে মানুষের কোনো শারিয়াহ দরকার ছিল না। তাওরাত ছিল প্রথম শারিয়াহ। কু’রআনে সেই শারিয়াহকে যুগোপযোগী করার জন্য এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো মীমাংসা করার জন্য আরও উন্নত শারিয়াহ দেওয়া হয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন—আল্লাহ تعالى কেন একটাই ধর্ম দিলেন না? কেন ইহুদি, খ্রিষ্টান, ইসলাম, হিন্দু এতগুলো ধর্ম দিলেন?
প্রথমত, আল্লাহ تعالى মোটেও এতগুলো ধর্ম দেন নি। আদম عليه السلام থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ عليه السلام পর্যন্ত আল্লাহ মানুষকে একটাই ধর্ম দিয়েছেন “ইসলাম”, যার অর্থ আল্লাহর تعالى ইচ্ছার কাছে আমাদের ইচ্ছার আত্মসমর্পণ। মানুষই আদি ধর্ম গ্রন্থগুলোকে বিকৃত করে, নিজেদের বানানো নাম দিয়ে আলাদা আলাদা ধর্ম বানিয়ে ফেলেছে। ধর্মগুলোর নামগুলো দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে, সেই ধর্ম গুলো আসলে মানুষের বানানো। জুডায়িজম (ইহুদি) ধর্মের নাম এসেছে জুডা নামের একটি গোত্র থেকে। খ্রিষ্টান ধর্মের নাম এসেছে খ্রিস্ট থেকে। বাইবেলের কোথাও আপনি এই নামগুলো খুঁজে পাবেন না। হিন্দু ধর্মের নাম এসেছে হিন্দুস্থান থেকে। বেদান্তিক ধর্মের নাম এসেছে বেদ ধর্মগ্রন্থের নাম থেকে। ইসলাম একমাত্র ধর্ম যার নাম সেই ধর্মের মূলগ্রন্থে সৃষ্টিকর্তা নিজেই বলে দিয়েছেন। বাকি সব ধর্মের নাম মানুষের দেওয়া। তাওরাত, ইনজিল, যবুর, কু’রআন—সব ধর্মগ্রন্থ একটাই ধর্ম প্রচার করে গেছে: ইসলাম।
এবার আয়াতটির শেষের অংশটি দেখুনঃ
“… তারা পরকালে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে।”
এখানে আল্লাহ يُوقِنُونَ ব্যবহার করেছেন, যা ইয়াকি’ন থেকে এসেছে।—এর অর্থ কোনো ব্যাপারে একেবারে সন্দেহাতীত ভাবে বিশ্বাস করা। যেমন: আমরা জানি আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। এ নিয়ে আমাদের কারও কোনো সন্দেহ নেই। আমরা এটা কোনো কারণে এতটাই সন্দেহাতীত ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমরা কেউ কৌতূহলের বসেও আগুনে হাত দিয়ে দেখতে যাব না: সত্যিই হাত পোড়ে কি না। ইয়াকি’ন হচ্ছে ঠিক এই ধরনের সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করা।
এখানে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, মুত্তাকীরা সন্দেহাতীত ভাবে আখিরাতে বিশ্বাস করে, অর্থাৎ তাদের মনে কোনো সন্দেহই নেই যে, একদিন সব ধ্বংস হয়ে যাবে, তাদেরকে আবার জীবিত করা হবে, তাদের সব কাজের বিচার হবে। তারা যেন একদম নিজের চোখে জাহান্নামের ভয়ংকর আগুন দেখতে পায়, একদম নিজের কানে জান্নাতের ঝর্ণার কলকল ধ্বনি শুনতে পায়।
একবার আমার হাতে গাড়ির রেডিয়েটর বার্স্ট করেছিল। রেডিয়েটরের ভিতরে অতি উত্তপ্ত পানি থাকে। সেই পানি লেগে পুরো হাত, ঘাড়ের চামড়া ঝলসে গিয়েছিল। গরুর গলায় যেমন একগাদা চামড়া ঝুলে থাকে, সেরকম আমার হাত থেকে একগাদা চামড়া ঝুলতে থাকতো। ছোট বাচ্চারা ভয়ে আমার কাছে আসতো না। আমি তিন দিন, তিন রাত যতক্ষণ জেগে থাকতাম প্রচণ্ড ব্যথায় গোঙাতাম আর আল্লাহকে تعالى ধন্যবাদ দিতাম: আমাকে জাহান্নামের আগুনের একটা স্যাম্পল এই পৃথিবীতেই দেওয়ার জন্য, কারণ, এরপরে আমার জাহান্নামের আগুন সম্পর্কে ইয়াকি’ন না হলেও, যথেষ্ট কঠিন ধারণা হয়ে গিয়েছিল।
একইভাবে জান্নাত কেমন হবে, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে হলে এবং জান্নাতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি করতে হলে, আমাদের সবার উচিত আল্লাহর تعالى তৈরি এই অসাধারণ সুন্দর পৃথিবীটা ঘুরে দেখা এবং সৃষ্টিজগতকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা। আল্লাহ تعالى পৃথিবীটাকে অনেক সুন্দর করে বানিয়েছেন, যেন আমরা জান্নাত কত সুন্দর হবে, সেটা কিছুটা হলেও ধারণা করতে পারি। তিনি জানেন যে, চোখে না দেখলে আমাদের জন্য কোনো কিছু বিশ্বাস করা কঠিন এবং সেটা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি করা আরও কঠিন। একারণেই তিনি পৃথিবীকে অসম্ভব সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, যেটা দেখে আমরা তাঁর অসাধারণ সৃজনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যাব এবং জান্নাতে যাবার জন্য এমন আগ্রহ তৈরি করতে পারব যে, দুনিয়ার কামনা-বাসনা-মোহ কোনোটাই আমাদেরকে জান্নাতে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা থেকে দূরে রাখতে পারবে না।
কয়েক বছর আগেও আমি জান্নাতের কথা খুব একটা ভাবতাম না। আমার কথাবার্তা, কাজকর্মে, চালচলনে এমন কিছু ছিল না, যেটা দেখে কেউ বলতে পারত যে, আমি জান্নাতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট আগ্রহী। তারপর একদিন আমি লেক ডিসট্রিক্টে গেলাম। বিশাল এক পাহাড়ে চার ঘণ্টা উঠে সামনে তাকিয়ে দেখলাম যতদূর চোখ যায় খোলা নীল আকাশের নিচে বিশাল সব পাহাড়ের সারি এবং তার মাঝখানে এক পরিষ্কার নীল হ্রদ। হঠাৎ করে এই প্রচণ্ড সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়ে আমি ‘থ’ হয়ে গেলাম।
জান্নাতের বর্ণনা দেওয়া একের পর এক আয়াত আমার মনের মধ্যে আসতে লাগল। ভিজে আসা চোখে আমি তাকিয়ে থাকলাম আর আফসোস করতে থাকলাম, আমার মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে কতবার বলেছেন এই অসাধারণ সৌন্দর্য আমি লক্ষ কোটি বছর, অনন্তকাল উপভোগ করতে পারব—দরকার আমার পক্ষ থেকে একটু চেষ্টা, একটু ত্যাগ—কিন্তু আমি সেটা করিনি।
আখিরাতে এত গভীর বিশ্বাস—কেন মুত্তাকী হওয়ার জন্য একটা শর্ত? আখিরাতে এরকম সন্দেহাতীত বিশ্বাসের প্রয়োজন কী? কেন আল্লাহ تعالى একে এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন যে, তিনি কু’রআনের শুরুতেই এই ব্যাপারটি পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন?
যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ জাহান্নামের ভয়ংকর শাস্তি মনে প্রাণে উপলব্ধি করতে না পারছে এবং জান্নাতের সুখের উপর নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে না পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ধর্ম শিখিয়ে কোনো লাভ হবে না। ধর্ম তার কাছে শুধুই কিছু তত্ত্ব কথা হয়ে থাকবে। ধর্মীয় নিয়মকানুনগুলো মানার জন্য সে কোনো আগ্রহ খুঁজে পাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য মানুষ তাকে দেখতে পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকবে, কিন্তু তারপর একা হলেই তার আসল চেহারা বের হয়ে যাবে। দেশের আইন-কানুন তাকে হয়তো সমাজে, ঘরের বাইরে অন্যায় করা থেকে দূরে রাখতে পারে। কিন্তু কোনো নির্জন রাস্তায়, অন্ধকার পার্কে, নিজের ঘরের ভেতর, নিজের পরিবারের সাথে, নিজের সাথে জঘন্য কাজ করা থেকে তাকে আটকাতে পারবে না। এর জন্য একমাত্র সমাধান হচ্ছে তাকওয়া এবং বিশেষ করে আখিরাতের প্রতি প্রচণ্ড বিশ্বাস।
আখিরাতের উপর মানুষের বিশ্বাস তৈরি করতে না পারলে কী হয়, তার ভয়াবহ উদাহরণ পাশ্চাত্যের দেশগুলো। সেই দেশগুলোতে আইন খুবই কঠিন, আইনশৃঙ্খলা বাস্তবায়ন করার জন্য বাহিনীর কোনো অভাব নেই, রাস্তা ঘাটে, দোকানপাটে সিকিউরিটি ক্যামেরার কোনো অভাব নেই। কিন্তু তারপরেও সেই দেশগুলোতে যেসব জঘন্য অন্যায় হয় এবং যে পরিমাণে হয় তা যেকোনো মুসলিম দেশের পরিসংখ্যানকে বহুগুনে ছাড়িয়ে যাবে। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রতি ৬জন নারীর মধ্যে একজন ধর্ষণের শিকার হয়।[১০৭] মাসে ৫৬,০০০ -এর বেশি, ঘণ্টায় ৭৮টি ধর্ষণ হয়।[১০৮]
সুইডেন বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ, বসবাসযোগ্য, সুখময় ৫টি দেশের মধ্যে একটি। সেখানে শিক্ষার হার সবচেয়ে বেশি ৯৯%; বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে এটি ইউরোপের দ্বিতীয় শীর্ষতম দেশ। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যে দেশ দান করে সেটা সুইডেন।[১১০] কিন্তু সেই দেশে ধর্ষণের পরিমাণ পুরো ইউরোপে সবচেয়ে বেশি, এমনকি ইংল্যান্ডের মত সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক অবক্ষয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া একটি দেশের থেকেও দ্বিগুণ।[১০৭] শুধু শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থ, বিত্ত, আইন,শৃঙ্খলা থাকলেই যে মানুষকে পশু হওয়া থেকে আটকে রাখা যায় না, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সুইডেন।[১১১] আরও উল্লেখযোগ্য হলো, সুইডেন বিশ্বের তৃতীয় নাস্তিক প্রধান দেশ।
ইংল্যান্ডে প্রতি সেখানে প্রতি চার জনের একজন কিশোর-কিশোরী যৌন অত্যাচারের শিকার হয়।[১১২] আমেরিকাতে প্রতিবছর বাচ্চাদের নিয়ে বানানো পর্নমুভি থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যবসা হয়।[১০৮] এই হলো আধুনিক দেশের কঠিন আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা থাকার পরের অবস্থা। আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে মানুষ যে নিকৃষ্টতম পশু হয়ে যেতে পারে, তার উদাহরণ হলো এসব ধর্মবিমুখ পাশ্চাত্য দেশগুলো।
নাস্তিকদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, নাস্তিকরা নৈতিকভাবে ধার্মিকদের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো হয়। তাদের দৃষ্টিতে ধার্মিক মানুষরা হচ্ছে অর্ধশিক্ষিত, বর্বর ধরনের, নিচু নৈতিকতার মানুষ; এরা চারটা বিয়ে করে, বউদেরকে ঘরে আটকে রাখে, ছেলে মেয়েদেরকে শিক্ষিত হতে দেয় না। একারণে নাস্তিকরা একটি ধারণা সবার মধ্যে প্রচার করার চেষ্টা করছে: “মানুষের ভালো থাকার জন্য ধর্মীয় বইগুলোর কোনো দরকার নেই। মানুষ নিজেই নৈতিক নিয়ম-কানুন তৈরি করতে পারে এবং প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার নিজের নৈতিকতার ধারণা এবং মূল্যবোধ অনুসারে জীবনযাপন করার। ধর্ম কারও উপর নৈতিকতা, মূল্যবোধ জোর করে চাপিয়ে দিতে পারে না। এটা অন্যায়।
যারা এই ধারণায় বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি একটা প্রশ্ন করতে পারেন (খুবই আপত্তিকর, কিন্তু তাদের মোটা মাথায় ঢোকানোর জন্য লিখতে বাধ্য হচ্ছি), “ভাই, আপনার স্ত্রীকে আমার ভালো লেগেছে। আজকে রাতে আমি তাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো। আমার দৃষ্টিতে এটা কোনো অনৈতিক কাজ নয়, কারণ আপনার স্ত্রীরও আমার সাথে যেতে কোনো আপত্তি নেই। মাঝখান থেকে আপনি কোনো বাঁধা দিলে, সেটা একটা অনৈতিক ব্যাপার হবে, কারণ আপনি— আমার এবং আপনার স্ত্রীর চাওয়ার মধ্যে বাঁধা দিতে পারেন না।”
দেখুন তাদের নৈতিকতা কোথায় যায়। তাদের যুক্তি অনুসারে যদি পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ চলত, তাহলে মানব সমাজগুলো একেকটা চিড়িয়াখানা হয়ে যেত, যেখানে মানুষ আর বানরের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতো না। পৃথিবীর বাকি দেশগুলো সুইডেন হতে আর বেশি বাকি থাকতো না।
কানাডাতে University of Lethbridge ১৬০০ মানুষের উপর পরিসংখ্যান নিয়ে দেখিয়েছে যে, যারা নাস্তিক, তাদের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ, ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের থেকে অনেক ক্ষেত্রে আশংকাজনক ভাবে খারাপ। যেমন: ক্ষমা, নম্রতা, ধৈর্য, উদারতার মাপ কাঠিতে ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের থেকে নাস্তিকরা প্রায় অর্ধেক—[১১৪]
একারণেই আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সূরা বাকারার শুরুতেই বলে দিয়েছেন যে, আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সবসময় দেখছেন—এই ব্যাপারে যারা সবসময় পূর্ণ সচেতন থাকে, যারা মানুষের চিন্তার বাইরে এমন সব বিষয়ে বিশ্বাস করতে পারে, যারা সালাতকে তাদের জীবনে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে, যারা নিজেদের সম্পদকে আল্লাহর تعالى দেওয়া উপহার মনে করে মানুষকে বিলিয়ে দিতে পারে এবং যারা নবী عليه السلام এবং তার আগে পাঠানো ঐশীবাণীর উপর বিশ্বাস রাখতে পারে—
তারাই তাদের প্রভুর কাছ থেকে আসা সঠিক পথে আছে এবং তারাই নিশ্চিতভাবে সফল।
আল্লাহ تعالى এখানে মুত্তাকিদেরকে—যারা তাদের জীবনে সফল হতে পারে—তাদেরকে مُفْلِحُون বলে সম্বোধন করেছেন, যা فَلاّح ফাল্লাহ অর্থাৎ কৃষক বা চাষি শব্দটি থেকে এসেছে। কৃষক তার কাজের প্রতিদান সপ্তাহে বা মাসে একবার পায় না। সে দীর্ঘ পরিশ্রম করে জমি চাষ করার পর আশা নিয়ে বুক বেধে থাকে যে, একদিন ভালো ফলন হবে। কৃষক জানে যে, সে নিজে শুধু পরিশ্রম করলেই হবে না। তার আল্লাহর تعالى অনুগ্রহ দরকার—ঠিকমত রোদ এবং যথেষ্ট বৃষ্টি দরকার। না হলে তার এত পরিশ্রম সব বিফলে যাবে। আল্লাহ تعالى এখানে মুফ্লিহুন শব্দটি ব্যবহার করে মুত্তাকীদেরকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তাদের জীবনটা মোটেও সহজ হবে না। তাদেরকে যদি জান্নাত পেতে হয়, তাহলে তাদেরকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে এবং শুধু পরিশ্রম করলেই হবে না, আল্লাহর تعالى অনুগ্রহ না পেলে তাদের সব পরিশ্রম বিফলে যাবে। তারা লম্বা পরিশ্রম করার পর একদিন গিয়ে বিরাট প্রতিদান পাবে। তাই মুত্তাকীদেরকে কৃষকদের মতো ধৈর্য ধরতে হবে, একটানা পরিশ্রম করে যেতে হবে এবং আল্লাহর تعالى অনুগ্রহের উপর নির্ভর করতে হবে। একারণেই আল্লাহ تعالى সবচেয়ে উপযুক্ত মুফ্লিহুন শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
সুত্র:
- [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার।
- [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
- [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
- [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
- [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
- [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
- [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
- [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
- [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
- [১০৫] http://islamqa.info/en/159831
- [১০৬] http://islamqa.info/en/4983
- [১০৭] http://en.wikipedia.org/wiki/Rape_statistics
- [১০৮] http://listen.nycagainstrape.org/learn.html
- [১০৯] https://wsr.byu.edu/pornographystats
- [১১০] http://www.thelocal.se/40142/20120407/
- [১১১] http://www.thelocal.se/19102/20090427/
- [১১২] http://www.nspcc.org.uk/Inform/resourcesforprofessionals/sexualabuse/statistics_wda87833.html
- [১১৩] http://ejtaal.net/m/aa/#HW4=862,HW3=745,LL=6_222,LS=2,HA=586,SG=822,BR=746,PR=121
- [১১৪] Good Without God, But Better With God? by Reginald W. Bibby
- [১১৭] খ্রিস্টান পাদ্রীর কু’রআন পোড়ানো — http://www.christianpost.com/news/florida-residents-tell-quran-burning-pastor-terry-jones-not-in-our-town-102644/
- [১১৯] বাইবেলে ইয়াকুব নবীর স্রষ্টার সাথে হাতাহাতির মিথ্যাচার — http://biblehub.com/genesis/32-28.htm
- [১২০] বাইবেলে স্রষ্টার মানুষ সৃষ্টির পরে দুঃখ প্রকাশের মিথ্যাচার — http://biblehub.com/genesis/6-6.htm
- [১২১] বাইবেলে লুত নবীর অন্যায় আচরণের মিথ্যা কাহিনী — http://biblehub.com/genesis/19-35.htm