তোমরা যা কিছুই খরচ করো, বা যেটাই মানত করো, আল্লাহ অবশ্যই তা জানেন। আর যালিমদের সাহায্য করার কেউ নেই। [আল-বাক্বারাহ ২৭০]
আমরা যা কিছুই খরচ করি, সেটা আল্লাহর تعالى রাস্তায় হোক, বা অন্য কোনো অসৎ কাজে হোক না কেন, আল্লাহ تعالى তা অবশ্যই জানেন। রাস্তায় চলার সময় এক অন্ধ ফকিরকে দেখে খুব খারাপ লাগলো, পকেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে চুপচাপ তার হাতে গুঁজে দিলেন, সেটা আর কেউ না দেখলেও আল্লাহ تعالى অবশ্যই দেখলেন। কেউ রাস্তার মধ্যে ময়লা ফেলে গেছে। মানুষ কষ্ট করে তা পাশ কাটিয়ে হেটে যাচ্ছে। আপনি নিজের টাকা খরচ করে কাউকে ডেকে এনে তা পরিষ্কার করে দিলেন। এর জন্য কেউ আপনাকে কোনো ধন্যবাদ দিলো না, কোনো পদক দিলো না, ইলেকশনে দাঁড়াতে আমন্ত্রণ জানালো না। কিন্তু আল্লাহ تعالى ঠিকই তা দেখেছেন। আপনার জন্য সম্মান পদক-এর থেকেও বিরাট কিছু অপেক্ষা করছে।
আমরা সাধারণত প্রকাশ্য ভালো কাজগুলো করার সময় আল্লাহর تعالى কথা ঠিকই মনে রাখি। আল্লাহ تعالى এবং মানুষরা যেন আমাদের ভালো কাজগুলো ঠিকভাবে খেয়াল করেন, প্রতিদান দিতে যেন কম-বেশি না হয়, সেজন্য চেষ্টা করতে ভুলি না। কিন্তু খারাপ কাজগুলো করার সময় বেমালুম আল্লাহর تعالى কথা ভুলে যাই, না হলে একধরনের জোর করে নিজেকে ভুলিয়ে রাখি। যখন বিবেকের দংশন বেশি হয়ে যায়, তখন বিবেককে সান্ত্বনা দেই যে, আশেপাশে মানুষ কত বড় বড় খারাপ কাজ করছে, আর আমার এই অল্প খারাপ কাজে কিই বা যায় আসে? অথবা, আমি না করলে কী হবে, অন্য সবাই করছে না? —একারণে সরকারি কাজে ঘুষ দিয়ে কন্ট্রাক্ট নেওয়ার সময় আমাদের হাত কাঁপে না। কাউকে পয়সা খাইয়ে নিজের কাজ অন্যদের আগে করাতে একটুও বাধে না। বেশি লাভের লোভে খাবারে ভেজাল, বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে বাজারে ছাড়তে বুক কাঁপে না। এইসব কাজ করার সময় আমরা ভুলে যাই যে, আমাদের সব কাজ আল্লাহ تعالى দেখেন। ভীষণ নির্যাতন অপেক্ষা করছে এই সব যালিমদের জন্য।
এই আয়াতে তিনি تعالى বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেছেন যে, অবশ্যই, শুধুই আল্লাহ تعالى জানেন আমরা আসলে কী নিয়তে আল্লাহর পথে খরচ করি, বা মানত করি। অন্য কেউ না জানলে কী হবে। আমরা সবার সামনে ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকতে পারি। এমনকি নিজেকেও আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারি এই বুঝিয়ে যে, আমি আসলে আল্লাহর تعالى জন্যই খরচ করছি, বা মানত করছি। কিন্তু আমাদের অন্তরের ভেতরের অন্তরে আসলে কী উদ্দেশ্য কাজ করছে, সেটা সবচেয়ে ভালো জানেন আল্লাহ تعالى।
মানত কী?
نذز বা মানত বলতে এই নিয়ত করা যে, আমার অমুক কাজটা যদি হয়ে যায়, অথবা অমুক বিপদ থেকে আমি যদি মুক্তি পাই, তাহলে আল্লাহর تعالى রাস্তায় আমি এতটা পরিমাণ সাদাক্বা করবো। এধরনের মানত করে ফেললে, তা পূরণ করা জরুরি। তবে ইসলামে মানত করাটা জরুরি নয়। এটি কোনো ইবাদত নয়। ইসলাম বরং মানত করতে কোনো উৎসাহ দেয় না, উল্টো নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু একবার মানত করে ফেললে, তখন তা পূরণ করাটা ইবাদাত হয়ে যায়। “অমুক পেলে আমি অমুক করবো”, এই মানত না করে, বরং যা করবো বলে ঠিক করেছিলাম, সেটা আগে করে, তারপর আল্লাহর تعالى কাছে সেটার ওয়াসিলায় চাওয়াটাই বেশি ভালো।[১৭][১৮] এতে করে দুটো লাভ— ১) যা চেয়েছিলাম, তা না পেলেও, অন্তত একটা ইবাদাত করার বিরাট সওয়াব পেয়ে যাচ্ছি, ২) সেই ভালো কাজের বিনিময়ে হয়ত যা চেয়েছিলাম, তার থেকে বেশি ভালো কিছু আল্লাহ تعالى দেবেন।
আমরা নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কেন আমি মানত করছি যে, আমার সন্তান পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে আমি গরিব ডেকে খাওয়াবো? কেন আমি আগেই গরিব ডেকে খাইয়ে তারপর আল্লাহর تعالى কাছে সন্তানের জন্য দুআ করছি না?
কেন আমি মানত করছি যে, আমার বিপদ দূর হয়ে গেলে আমি হাজ্জ করতে যাবো? কেন আমি আত্মীয়স্বজনদের বিপদে উপকার করে আল্লাহর تعالى কাছে নিজের বিপদ থেকে মুক্তির জন্য দুআ করছি না?
কেন আমি মানত করছি যে, আমি সুস্থ হয়ে গেলে এতিম খানায় দান করবো? কেন আমি নিয়মিত এতিম খানায় দান করে আল্লাহর تعالى কাছে সুস্থ হওয়ার জন্য দুআ করছি না? “যদি সুস্থ না হই? যদি টাকাগুলো শুধু শুধু জলে যায়?” —এধরনের অসুস্থ চিন্তা তো কোনো মুসলিমের থাকার কথা না।
আমার যা চাই, সেটা হলে তবেই আল্লাহর تعالى জন্য কিছু করবো, না হলে করবো না—এধরনের ব্যবসায়ী মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। ইসলাম এই কাজে উৎসাহ দেয় না। আল্লাহর تعالى কোনোই দরকার নেই আমাদেরকে কিছু দেওয়ার। আমরা যা কিছুই পাই, সবই তাঁর تعالى দয়ায় পাই। তবে মানত যদি এমন হয় যে, আল্লাহ تعالى বাধা দূর করে না দিলে কোনো একটি বিশেষ ইবাদত কোনোভাবেই করতে পারবো না, যেমন আর্থিক সামর্থ্য না দিলে হাজ্জ করতে পারবো না, তাহলে সে ধরনের মানত করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও থাকবে না। তবে সেক্ষেত্রেও মানতের পাশাপাশি অন্য নফল ইবাদাত বেশি করে আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাওয়া ভালো।
আজকাল অনেক প্রসিদ্ধ মাজারে গিয়ে মানত করার জন্য নযরানা দেওয়া হয়। এগুলো শিরক। মানত করার সময় শিরক হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। এজন্য তা না করাই ভালো।[১৭]
যালিমদের সাহায্য করার কেউ নেই
হঠাৎ করে যালিমদের কথা কেন আসলো? আল্লাহর تعالى পথে খরচ করা, বা মানত করার সাথে যালিমদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?
যালিম শব্দের অর্থ, যে ব্যক্তি কোনো কিছুকে যেভাবে থাকার কথা, সেভাবে রাখে না। যেমন লোক দেখানোর জন্য দান করা। যে লোক দেখানোর জন্য দান করে, তাকে আল্লাহ تعالى যালিম বলেছেন, কারণ সে তার সম্পদ অযোগ্য জায়গায় দান করে। আবার অন্যায় কাজে মানত করাও যুল্ম।[১২] আল্লাহর تعالى পথে দান করার নাম করে যে তার সম্পদ অন্যায়ভাবে দেয়, বা অন্যায় জায়গায় খরচ করে, সে যালিম। যে তার অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মানত করে, সে যালিম। একইসাথে যারা আল্লাহর تعالى পথে খরচ করার এত প্রয়োজন দেখার পরেও না দেখার ভান করে নিজের সম্পদ আঁকড়ে ধরে রাখে, শুধু নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে, এরা যালিম। যারা মানত করে, তারপর নিজের কাজ হাসিল হয়ে যাওয়ার পর মানত পূরণ করে না, তারাও যালিম। —এদের সাহায্য করার কেউ থাকবে না। এদের জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে।
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স