দান করে তারপর খোটা দেওয়া, কথা শোনানো কতটা খারাপ, তা আল্লাহ تعالى আবারো আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন—
বিশ্বাসীরা শোনো, দানের কথা মনে করিয়ে খোটা দিয়ে এবং কষ্ট দিয়ে তোমাদের দানকে বরবাদ করে দিয়ো না, সেই লোকের মত, যে কিনা দান করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে না। ওর উদাহরণ হলো একটা বড় পাথরের মতো, যার উপরে কিছুটা মাটির আস্তর জমে, কিন্তু তারপর ভারি বৃষ্টি এসে সব মাটি ধুয়ে আবার খালি পাথর রেখে যায়। সে যা অর্জন করলো, তার কিছুই তার আর কাজে লাগলো না। আল্লাহ অবিশ্বাসী লোকদের পথ দেখান না। [আল-বাক্বারাহ ২৬৪]
“দেখেন ভাবি, বুয়াকে এই ঈদে এই নতুন কাপড়টা কিনে দিয়েছি। ও সবসময় পুরনো ছেড়া একটা কাপড় পড়ে আসতো। এখন ওকে কত ভালো দেখাচ্ছে না?” অথবা, “ভাই সাহেব, আপনাকে আমি অনেকদিন থেকে সাহায্য করে আসছি। এবার আপনি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন, নাকি? আপনি কি সারাজীবন আমার ঘাড়ে ঝুলে থাকবেন?” —অনেক সময় আমরা যাদেরকে দান করি, তাদেরকে নানা ভাবে কষ্ট দিই। তাদের অভাবের কথা বার বার মনে করিয়ে দিই। তাদেরকে যে আমি কত উপকার করছি, সেটা সুযোগ পেলেই জানান দিই। তাদের কাছ থেকে ফুটফরমাশ একটু কম পেলেই দানের কথা মনে করিয়ে দিই, যেন সে আমার দানের প্রতিদান দিতে কোনো গাফিলতি না করে। এসব করে আমরা আমাদের দানকে পুরোপুরি বাতিল করে দিই।
আল্লাহ تعالى একটা কঠিন উপমা দিয়েছেন। যারা মানুষকে দান করে তারপর অন্যের সামনে সেটা বলে বেড়ায়, শুধুমাত্র আল্লাহকে تعالى খুশি রাখার কথা ভুলে যায় অথবা আল্লাহকে تعالى খুশি করাটা তাদের আসল উদ্দেশ্য থাকে না, তাদেরকে আল্লাহ تعالى এক বড় পাথরের সাথে তুলনা করেছেন। পাথরের শক্ত আবরণে একসময় একটু মাটির আস্তর পড়ে, একটু নরম হয়। কিন্তু তারপর এক বৃষ্টি এসে সেই নরম মাটির স্তর ধুয়ে দেয়, আবার পাথরের শক্ত আবরণ বের হয়ে যায়। এভাবে আমাদের পাথরের অন্তরটাকে আমরা দান করে একটু নরম করি, তারপর সেটা মানুষকে বলে বেড়িয়ে আবার রুক্ষ পাথরে ফিরে যাই। যা অর্জন করেছিলাম, যা সব ধুয়ে শেষ হয়ে যায়।
যেসব মানুষ আখিরাতের প্রতিদানে গভীর বিশ্বাস রাখে না, শুধু তারাই দান করে সেটা মানুষকে বলে বেড়ানোর মত জঘন্য কাজ করতে পারে। আর যে অভাবী মানুষকে দান করে তারপর তাকে কথা শোনায়, কষ্ট দেয়, তার মত পাষাণ মানুষের আখিরাতে বিশ্বাস থাকতে পারে না। আখিরাতের বিচারে এবং প্রতিদানে যদি কারও বিশ্বাস থাকে, তাহলে সে ভুলেও কোনোদিন তার দানের কথা বলে বেড়াতে যাবে না। আর যাকে দান করেছে, তাকে সেটা মনে করিয়ে দেওয়া, বা তাকে কোনো ধরনের কষ্ট দিয়ে দানের সওয়াব বাতিল করে দেওয়ার মত বোকামি করার তো প্রশ্নই ওঠে না।
আয়াতের শেষ অংশটি ভয়ংকর, “আল্লাহ অবিশ্বাসী লোকদের পথ দেখান না।” — অবিশ্বাসী বা কাফির শব্দটা খুবই কঠিন শব্দ। কিন্তু আল্লাহ تعالى এই আয়াতে আমাদেরকে শেখাচ্ছেন যে, যাদের কাছে দান করাটা লোক দেখানো কাজ, যারা মানুষকে দান করে তারপর কষ্ট দেয়, এরা আসলে আল্লাহকে تعالى এবং আখিরাতে বিশ্বাস করে না। কারণ যদি এরা আল্লাহ تعالى এবং আখিরাতে বিশ্বাস করতই, তাহলে তারা কোনোদিন এই কাজ করত না। আরা যারা আল্লাহ تعالى এবং আখিরাতে বিশ্বাস করে না, তারা হচ্ছে অবিশ্বাসী। এদেরকে আল্লাহ تعالى পথ দেখাবেন না। যাদেরকে আল্লাহ تعالى পথ দেখাবেন না, তাদের পরিণতি জাহান্নাম।
আর যে আল্লাহকে খুশি করার আশায় এবং নিজের বিশ্বাসকে মজবুত রাখার জন্য তার সম্পদ খরচ করে, তার উপমা হলো উঁচু ভূমিতে গাছে ঘেরা এক ঘন সবুজ বাগানের মতো, যেখানে ভারি বৃষ্টি হলে দ্বিগুণ ফলন হয়। আর ভারি বৃষ্টি যদি না-ও হয়, হাল্কা ঝিরঝির বৃষ্টিই তার জন্য যথেষ্ট। তোমরা যা কিছুই করো, আল্লাহ তার সব দেখেন। [আল-বাক্বারাহ ২৬৫]
আমাদের দানের উদ্দেশ্য যেন হয় শুধুই আল্লাহর تعالى সন্তুষ্টি পাওয়ার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা। যারা আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা থেকে তার সম্পদ আল্লাহর تعالى পথে খরচ করে, তাদেরকে আল্লাহ تعالى জান্নাত অর্থাৎ এক ঘন গাছের ছায়ায় ঘেরা বাগানের সাথে তুলনা করেছেন, যেটা আবার উঁচু ভূমিতে উর্বর জমিতে গড়ে উঠেছে। উঁচু ভূমির কারণে সেটি সুরক্ষিত, নিরাপদ।[১৪][১৭][৭] সেখানে ভারি বৃষ্টি হলে দ্বিগুণ ফলন হয়। আবার হাল্কা ঝিরঝির বৃষ্টি হলেও ফলন হয়। এই উপমাটার মানে হলো যে, কত বেশি দান করলো সেটা কোনো ব্যাপার না। টাকার পরিমাণের সাথে পুরস্কারের কোনো সম্পর্ক নেই। আসল ব্যাপার হচ্ছে আন্তরিকতা, আল্লাহকে تعالى খুশি করার ইচ্ছা।
এই আয়াতে একটি ব্যাপার লক্ষ করার মতো, “নিজের বিশ্বাসকে মজবুত রাখার জন্য তার সম্পদ খরচ করে” —বিশ্বাসীরা দান করে তাদের অন্তরকে শক্তিশালী করার জন্য। কারণ ঘরে বসে নামাজ, রোজা করা সোজা কাজ। কিন্তু নিজের কষ্টের সম্পদ কাউকে দান করা কঠিন ব্যাপার। দান করতে গেলেই মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তা শুরু হয়ে যায়, “যদি দান করি তাহলে বাচ্চার পড়ার খরচের জন্য টাকা থাকবে? আগামী কয়েকমাস বাড়ি ভাড়া দিতে পারবো? পরিবারের কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার টাকা কীভাবে দেব? গাড়ি-বাড়ি কেনার জন্য টাকা জমাবো কীভাবে?” — যখনি আমরা কোনো দান করার পরিস্থিতিতে পড়ি, তখনি আমরা একেক জন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হয়ে যাই। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের যাবতীয় সম্পদ, বিনিয়োগ এবং ঝুঁকির হিসাব মাথার মধ্যে গিজগিজ করতে থাকে।
একারণেই যারা নিজের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয়ে শেষ পর্যন্ত দান করতে পারেন, তাদের বিশ্বাস মজবুত হয়ে যায়, তাদের অন্তর শক্তিশালী হয়ে যায়। তাদের ভেতরে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। যেমন, আল্লাহর تعالى প্রতি আস্থা বেড়ে যায়, ভবিষ্যৎ নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা করা কমে যায়, অমূলক ভয়-ভীতিকে তারা জয় করেন, নেতিবাচক চিন্তা কমে যায়, অন্যের প্রতি আত্মত্যাগ করার মানসিকতা তৈরি হয়, সহমর্মিতা বোধ বাড়ে। একারণেই যারা নিয়মিত দান করেন, তাদের অন্তর মজবুত হয়, অল্পতেই মন ভেঙ্গে পড়ে না। দান করাটা হচ্ছে কঠিন পরিস্থিতিতেও অন্তরকে আল্লাহর تعالى আদেশ মানানোর জন্য এক ধরনের ট্রেনিং। দুর্ভিক্ষ, মহামারি বা কষ্টের সময় মানুষকে দান করা, যখন কিনা নিজেরই অভাব চলছে, আত্মীয়দেরকে দান করা যাদের সাথে সম্পর্ক ভালো না—এগুলো বেশ কঠিন কাজ। এগুলো আমাদেরকে সহজ, আরামের ইবাদতের গণ্ডি থেকে বের করে, কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর تعالى প্রতি আস্থা রাখা, তাঁর تعالى আদেশ মেনে চলার ট্রেনিং দেয়।[৭]
তোমাদের মধ্যে কেউ কি চাইবে যে, তার একটি গাছে ঘেরা ঘন সবুজ বাগান থাকুক, আঙুর এবং খেজুরে ভরা, যার ভেতর দিয়ে ঝর্ণা ধারা বয়ে যায়, যেখানে সব ধরনের ফল-ফসল হয়, আর সে একসময় বয়সের ভারে নুয়ে পড়ুক এবং তার সন্তানগুলোও হোক দুর্বল? তারপর এক আগুনের ঘূর্ণি এসে সব জ্বালিয়ে পুরিয়ে ছারখার করে দিক? এভাবেই আল্লাহ তোমাদেরকে তার বাণী পরিষ্কার করে দেন, যেন তোমরা চিন্তাভাবনা করো। [আল-বাক্বারাহ ২৬৬]
এখানে আরবদের জন্য আদর্শ বাগানের উপমা দেওয়া হয়েছে। এই বাগানের চারদিকের সীমানায় রয়েছে মজবুত খেজুর গাছের সারি, যা একধরনের প্রাচীর হিসেবে কাজ করে, বাগানকে পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। একইসাথে তা মরুভূমির তপ্ত বায়ুর প্রবাহ থেকে ভেতরটাকে রক্ষা করে। এর ছায়ায় গড়ে উঠেছে আঙুরের লতাময় গাছ, মাঝখানে নানাধরনের শস্য, ফলমূলের গাছ। একইসাথে সেটির ভেতরে দিয়ে পানির ধারা বয়ে যায়, যার কারণে কষ্ট করে সেচের পানির ব্যবস্থা করতে হয় না। ঘন সবুজ ছায়ায় ঘেরা একদম স্বপ্নের বাগান।[৭]
এই স্বপ্নের বাগানটা একটা আগুনের ঘূর্ণি এসে জ্বালিয়ে পুরিয়ে ছারখার করে দিলো। যদি মানুষটা বৃদ্ধ না হতো, তাহলে তার বাগান ধ্বংস হয়ে গেলেও সে আবার আরেকটা বাগান করে নিতে পারত। আবার যদি তার সন্তানরা সবল, সামর্থ্যবান হতো, তাহলে সেই সন্তানেরা আবার নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারত, মানুষটার তখন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু লোকটার অবস্থা সব দিক থেকেই খারাপ। সে একে তো বৃদ্ধ, তার উপর তার সন্তানরাও কোনো কাজের না। একারণে সে যখন তার এত কষ্টের বাগান হারিয়ে ফেলল, সে তখন একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেলো। তার নিজের এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ শেষ।[৪]
দান করে যারা মানুষকে নিজের উদারতার কথা বলে বেড়ায়, যাদেরকে দান করেছে, তাদেরকে কষ্ট দেয়, তাদের অবস্থা হচ্ছে এই রকম সর্বহারা মানুষের মতো। এদের সম্পদ চলে গেলো, সওয়াব চলে গেলো এবং এরা আল্লাহর تعالى কাছে ঘৃণিত হয়ে গেলো। এরা সবদিক থেকে নিঃস্ব, পরাজিত, অপমানিত।
সূত্র:
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স