কুরআনের কথা

যে নিজে থেকে ভালো কাজ করে, আল্লাহ অবশ্যই তার মূল্যায়ন করেন — আল-বাক্বারাহ ১৫৮

2_158_title

সাফা এবং মারওয়াহ আল্লাহর تعالى নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। তাই যারা কা’বা ঘরে হাজ্জ বা উমরাহ করে, তারা এদুটিকে ঘিরে ঘুরলে কোনো দোষ নেই। আর যে নিজে থেকে ভালো কাজ করে, আল্লাহ تعالى অবশ্যই তার মূল্যায়ন করেন, তিনি সব কিছুর ব্যাপারে জানেন। [আল-বাক্বারাহ ১৫৮]

সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর تعالى নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। এই আয়াতে নিদর্শন বলতে শা’আইর شَعَآئِرِ ব্যবহার করা হয়েছে, যার একবচন শা’ইরাহ شعيرة এসেছে شعر থেকে। এর অর্থ: কোনো স্থাপত্য, চিহ্ন, যা দেখে মানুষের কোনো উপলব্ধি হয়। কোনো কিছু দেখে আমরা যখন কোনো স্মৃতিচারণ করি, আমাদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয়, সেটা شعيرة।[১] যেমন বাঙালিদের شعيرة হচ্ছে স্মৃতিসৌধ, যা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। সেরকম সাফা এবং মারওয়া আমাদেরকে নবী ইব্রাহিম عليه السلام এর স্ত্রীর পানির খোঁজে ছোটাছুটি করার কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের ভীষণ কঠিন সব পরীক্ষা আল্লাহর تعالى প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখে নির্দ্বিধায় পার করার চেতনায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।

আজকে অবশ্য আমরা তাদের ভয়ঙ্কর কষ্টের কথা কিছুই অনুভব করি না। খোলা মরুভূমির তপ্ত বালুতে হাঁটা, মাথার উপর প্রখর সূর্য, গরম বাতাস, চারিদিকে ধু ধু মরুভূমি, উত্তপ্ত পাথরের টিলা —এগুলোর কিছুই আজ আর নেই। একশ বছর আগে হলেও আমরা হয়তো খোলা রাস্তায়, গরম বালুর মধ্যে হেঁটে, টিলা বেয়ে উপরে উঠে চারিদিক তাকিয়ে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতাম নবী ইব্রাহিমের عليه السلام স্ত্রী কী কষ্টটাই না করেছিলেন। এখন এগুলো শুধুই কিছু কল্পনা।

হাজার বছর আগে রাসুল মুহাম্মাদ عليه السلام -এর সময়ের আরব মুশরিকরা কা’বা এবং সাফা, মারওয়াতে অনেকগুলো মূর্তি রেখেছিল। তারাও কা’বা ঘিরে ঘুরপাক খেত, সাফা মারওয়া মধ্যে যাওয়া আসা করতো, তাদের মূর্তিগুলোকে পূজা করতো। এসব কারণে তখনকার অনেক মুসলিমের কাছে সাফা এবং মারওয়া ঘিরে ঘোরাটা আপত্তিকর মনে হয়েছিল। তারা অনেকে এটাকে শিরক বলে দাবি করছিল। তখন এই আয়াত নাজিল হয়ে সেই ভুল ধারণা সংশোধন করে দেওয়া হয়।[১৪]

অনেক অমুসলিমরা দাবি করেন: হিন্দুদের মতো মুসলিমরাও পূজা করে। দেখো না সবাই কা’বা মুখি হয়ে সালাত পড়ে? হাজ্জ হচ্ছে গণপূজা, যেখানে লক্ষ লক্ষ মুসলিম গিয়ে একদম কা’বার সামনে মাথা নত করে। দুটো জায়গা ঘিরে সাত বার চক্কর দেয়। এটাকে কি হিন্দুদের মতো আগুন ঘিরে সাত বার চক্কর দেওয়ার মতো হলো না?

প্রায় প্রতিটি ধর্মেই বিশেষ একটি জায়গা আছে যেখানে সারা পৃথিবী থেকে ধর্মপ্রাণ অনুসারীরা এসে একসাথে হন। এটা তাদের একতার প্রকাশ। এরকম একটি বিশেষ জায়গায় একসাথে হওয়াটা এটাই দেখিয়ে দেয় যে, সেই ধর্মের অনুসারীরা কোনো দেশ, জাতীয়তাবাদ, গায়ের রঙ, সমাজে স্ট্যাটাস, সম্পত্তি কোনো কিছুর পরোয়া করেন না। তাদের ধর্ম এসবের ঊর্ধ্বে। তারা নিজেদের মধ্যে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, একই জায়গায় একসাথে হয়ে, একই কাপড়ে, একইভাবে প্রার্থনা করেন। হাজ্জ মুসলিম জাতির এই অসাধারণ ঐক্য এবং সমতার নিদর্শন।

কা’বার পাশে ঘুরপাক দেয়াটা বৈজ্ঞানিভাবেও একটা চমৎকার পদ্ধতি। হাজার হাজার মানুষ যদি সোজা কা’বার দিকে হেঁটে যেত এবং তারপর সোজা হেঁটে ফেরত আসতো, তাহলে বিরাট বিশৃঙ্খলা, ধাক্কাধাক্কি লেগে যেত। কারো আর পুরো কা’বা একবারও ঘুরে দেখা হতো না। এর থেকে ট্রাফিক পরিচালনা করার জন্য ভালো পদ্ধতি হচ্ছে কোনো কিছুকে ঘিরে ট্রাফিক ঘুরতে থাকা, বাইরের থেকে ঘুরতে ঘুরতে ঢোকা এবং ঘুরতে ঘুরতেই বেরিয়ে যাওয়া।

এই পদ্ধতিটি এতই কার্যকর যে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে যেন ট্রাফিক জ্যাম না হয়, সেজন্য “রাউন্ডএবাউট” বলে একটা ব্যবস্থা আছে। রাস্তার মোড়ে গোলাকার একটা স্থাপনা থাকে। চারপাশ থেকে গাড়ি এসে সেই গোলাকার স্থাপনার চারিদিকে ঘুরতে থাকে। তারা ঘুরতে ঘুরতেই ঢোকে, তারপর ঘুরতে ঘুরতেই বেরিয়ে যায়। এভাবে গাড়ি নিয়ে যে কোনো রাস্তা থেকে প্রবেশ করে, যেকোনো রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়। রাস্তার মোড়ে কোনো ট্রাফিক লাইট দরকার হয় না। গাড়িগুলোকে অযথা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। ট্রাফিক লাইট ব্যবহার না করে রাস্তার মোড়ে এই অভিনব পদ্ধতির কারণে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম দূর করা যায়, সংঘর্ষ এড়ানো যায়, রাস্তার মোড়ে এসে গাড়িগুলোকে অনেক কম সময় অপেক্ষা করতে হয়, যখন চালকরা রাস্তার নিয়ম মেনে ভদ্রলোকের মতো গাড়ি চালান। কা’বার চারপাশে ঘোরার অবিকল এই একই পদ্ধতি আজকে ইংল্যান্ডে হাজার হাজার রাস্তার মোড়ে ব্যবহার হচ্ছে।

হাজ্জের আরেকটি রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে ২০-৩০ লক্ষ হাজি হাজ্জ করতে যাচ্ছেন। এটা দেখিয়ে দেয় যে, মুসলিমরা কোনো ছোটখাটো, দুর্বল জাতি নয়। লক্ষ লক্ষ ধনী মুসলিম পৃথিবীতে আছে, যাদের হাজ্জ করার খরচ বহন করার সামর্থ্য আছে। ২০-৩০ লক্ষ মানুষ একসাথে হওয়া বিরাট ঐক্যের নিদর্শন। হাজ্জিরা যখন সারা পৃথিবী থেকে হাজ্জে যান, শত দেশের বিমান-বন্দর, নৌবন্দর, এয়ারলাইন, নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যে সরগরম পড়ে যায়। মুসলিমদের এই বিরাট উৎসব সম্পর্কে লক্ষ লক্ষ অমুসলিম সচেতন হয়ে যায়। এই বিরাট ঘটনাটা অমুসলিম রাজনীতিবিদরা খুব ভালো করে লক্ষ্য করে।

“মুসলিমরা কা’বার পূজা করে” —অমুসলিমদের কা’বা সম্পর্কে এই ভুল ধারণার একটি বড় কারণ কিছু মুসলিমের কা’বার কাছে গিয়ে করা কাজকর্ম। হাজ্জের সম্প্রচারে দেখা যায়, কিছু মুসলিম মরিয়া হয়ে কা’বা ধরছে, কা’বার সাথে ঘষাঘষি করছে, কা’বার পাথরে চুমু খাওয়ার জন্য হাতাহাতি করছে। এগুলো দেখে যে কারো মনে হতে পারে যে, কা’বা হচ্ছে এক মহান পূজার বস্তু এবং মুসলিমরা আসলেই কা’বার পূজা করে।

মুসলিমরা কোনোভাবেই কা’বার পূজা করে না। মানুষ আবেগপ্রবণ প্রাণী। সারা জীবন ধরে হাজিদের স্বপ্ন ছিলো যে, কা’বাকে দু’চোখ ভরে দেখবে। কা’বাকে নিয়ে কত ঘটনা তারা শুনেছে, কত কল্পনা তারা করেছে। কা’বাকে দেখার কত দিনের স্বপ্ন তারা বুকে চেপে রেখেছে, কত কষ্ট করে হাজ্জে আসার টাকা জোগাড় করেছে। একারণে যখন কা’বা চোখের সামনে চলে আসে, তখন অনেকের আবেগের বাধ ভেঙ্গে যায় এবং এধরনের কাজ করে ফেলেন। কিন্তু এর মানে এই না যে, তারা কা’বার পূজা করছে।

অনেকেই জানে না যে, এই কা’বা এর মধ্যে কয়েকবার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। নবী ইব্রাহিম عليه السلام, রাসূল মুহাম্মাদ عليه السلام যেই কা’বা রেখে গিয়েছিলেন, সেই কা’বা সাথে এখনকার কা’বার বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এখন আমরা কা’বা বলতে বুঝি কালো কাপড়ে ঢাকা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সমান চারকোনা একটি স্থাপনা। কয়েকশ বছর আগেও এটা লাল, সবুজ, সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল। এমনকি প্রথমে কা’বা এখনকার মতো এরকম সমান চারকোনাও ছিল না, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ভিন্ন ছিল।[২৭৫] তাই নতুন করে বানানো এই স্থাপনাকে পূজা করার প্রশ্নই আসে না।

আর যে নিজে থেকে ভালো কাজ করে, আল্লাহ تعالى অবশ্যই তার মূল্যায়ন করেন

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন: وَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا — যে নিজে থেকেই ভালো কাজ করে। তাত্বাওওয়া’আ হচ্ছে নিজে থেকে কোনো কাজ করা, যা করার জন্য কেউ বাধ্য নয়। যেমন, নফল ইবাদতগুলো এর মধ্যে পড়ে। হাজ্জের সময় বাড়তি তাওয়াফ করা এর মধ্যে পড়ে। এছাড়াও যে কোনো ধরনের স্বেচ্ছায় করা ভালো কাজ, যা করা তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়, সেটাও এর মধ্যে পড়ে।[৪][১৪] خير হছে এমন ভালো কাজ, যা কাউকে বলে দিতে হয় না যে, এটা একটা ভালো কাজ, মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বুঝতে পারে যে, তা ভালো কাজ।[১] এধরনের যেকোনো স্বেচ্ছাসেবা, স্বেচ্ছায় করা ভালো কাজ আল্লাহ تعالى অবশ্যই লক্ষ্য করেন এবং অবশ্যই তার মূল্যায়ন করেন।

আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। দেখলেন ফুটপাথে এক জায়গায় মানুষ কলা, পান খেয়ে ফেলে রেখেছে। মানুষ সেগুলো পাড়িয়ে ফুটপাত ময়লা করে ফেলছে। আপনি সেটা ঝেড়ে পাশের ড্রেনে ফেলে দিলেন, ফুটপাতটা পরিষ্কার করে দিলেন। কেউ বলেনি আপনাকে এই কাজ করতে। আপনি এই কাজ করতে মোটেও বাধ্য নন। কিন্তু তারপরেও আপনি স্বেচ্ছায় এই ভালো কাজটা করলেন। এমনকি রাস্তায় কেউ আপনাকে তা করতেও দেখলো না। কেউ এসে আপনাকে একটা ধন্যবাদও দিলো না। কোনো দরকার নেই, কারণ আল্লাহ تعالى পুরোটাই দেখেছেন এবং তিনি নিজে এর মূল্য আপনাকে দেবেন। আল্লাহ تعالى হচ্ছে عَلِيمٌ — তিনি সবকিছুর ব্যাপারে সব জানেন। তিনি  شَاكِرٌ — কৃতজ্ঞ, মূল্যায়ন করেন।

এই আয়াতে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আল্লাহ تعالى বলছেন, আমরা যদি স্বেচ্ছায় ভালো কাজ করি, তাহলে তিনি হবেন শাকির, যার অর্থ: যে কারো প্রতি কৃতজ্ঞ। আল্লাহ কৃতজ্ঞ হবেন, এটা কী অদ্ভুত কথা! তাঁর বেলায় শাকির ব্যবহার করা মানায় না। শাকির বরং হবে তাঁর বান্দারা, তাঁর অসংখ্য নিয়ামতের জন্য! কিন্তু আল্লাহ تعالى এই আয়াতে এমন একটা শব্দ ব্যবহার করলেন, যা মুসলিমদেরকে লজ্জায় ফেলে দেয়। মুসলিমরা কিছু ভালো কাজ করছে, সাদাকা দিচ্ছে, নফল ইবাদাত করছে, এই আশায় যেন তারা আল্লাহর تعالى সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। অথচ আল্লাহই تعالى তাদের এই বাড়তি কাজকে সম্মান করে বলছেন যে, না, বরং তিনিই কৃতজ্ঞ হবেন তাদের এই স্বেচ্ছায় করা ভালো কাজগুলোর জন্য। কী সুন্দর আদাব আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে!

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version