যেমন আমি তোমাদেরই মধ্যে থেকে একজনকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছি, যে তোমাদেরকে আমার আয়াত শোনায়, পবিত্র করে, বিধি-বিধান এবং প্রজ্ঞা শেখায়। আর শেখায় যা তোমরা কখনো জানতে না। [আল-বাক্বারাহ ১৫১]
মানুষকে ইসলামের দাওয়াহ দেওয়ার সময় যারা দাওয়াহ দেন, তাদেরকে এই তিনটি বাধা পার করতে হয়—
১) তুমি কে? তোমার কথা আমি কেন শুনবো?
২) তোমার ধর্ম কি আমার ধর্মের থেকে বেশি সঠিক? তুমি কি মনে করো যে, তুমি সঠিক পথে আছে, আর আমরা সবাই ভুল পথে আছি?
৩) আমাদেরকে কেন সবদিক থেকে তোমাদের মতোই হতে হবে?
নবী, রাসূলদেরকে এই বাধাগুলো পার করতে হয়েছে। তাদেরকে এমন সব সময়ে, এমন সব মানুষের কাছে পাঠানো হয়েছিল, যারা একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একশ্রেণীর মানুষের চরম অন্যায়ের কারণে আরেক শ্রেণীর মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও নবী, রাসূলরা অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এই কঠিন বাধাগুলোকে অতিক্রম করে অত্যাচারী মানুষগুলোকে পথ দেখিয়ে গেছেন।
এখন আমাদের কাছে যদি বাইরের দেশ থেকে কেউ এসে ধর্ম প্রচার করা শুরু করে, তাহলে প্রথমেই আমাদের মনে হবে যে, সে কোথাকার কে, যে আমাদেরকে ধর্ম শেখাতে এসেছে? সে কীভাবে বুঝবে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের মানসিকতা, আমাদের সীমাবদ্ধতা? তার দেশে অনেক কিছু চলতে পারে, যেটা আমাদের দেশে চলবে না। আবার আমাদের অনেক কিছুই তার সংস্কৃতি অনুসারে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। আমাদেরকে কি সব দিক থেকে তার মতো, তার দেশের মানুষের মতো হতে হবে নাকি?
একারণে যখন কোনো নবী বা রাসুল তাদের এলাকার মানুষের মাঝে বড় হয়ে, তাদেরই মাঝে ধর্ম প্রচার করতেন, তখন তাদেরকে এই সমস্যাটার সম্মুখীন হতে হতো না। তারা তাদের আশেপাশের মানুষের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, মানসিকতা ভালো করে বুঝতেন এবং সে অনুসারে তাদেরকে ধর্ম শেখাতে পারতেন। একারণে একজন বাঙালি দাঈ যতটা না ভালোভাবে বাঙালীদের মাঝে ইসলামের শিক্ষা প্রচার করতে পারবেন, মানুষকে বোঝাতে পারবেন, মানুষের ভেতরে পরিবর্তন আনতে পারবেন, একজন আরব বা ইংরেজ দাঈ সেভাবে পারবেন না। ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, আদব-কায়দা একটা বিরাট বাধা হয়ে থাকবে সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতার পথে।
“যে তোমাদেরকে আমার আয়াত শোনায়”
রাসূল عليه السلام মানুষকে আল্লাহর تعالى বাণী তিলাওয়াত করে শোনান, তিনি নিজে থেকে কিছু বানিয়ে বলেন না। তিলাওয়াহ تلاوة এসেছে ت ل و থেকে, যার অর্থ হল- পেছনে পেছনে অনুসরণ করা, সারিবদ্ধভাবে চলা, কোনো কিছু অর্জনের জন্য চলা, কাউকে পথপ্রদর্শক হিসেবে নেওয়া, কারো কর্তৃত্ব মেনে নেওয়া, কোনো জীবনধারা অনুসরণ করা, কারো চিন্তার ধারা অনুসরণ করা ইত্যাদি।[২৬৩] রাসূল عليه السلام যা তিলাওয়াহ করেন তা তিনি নিজে আগে আল্লাহর تعالى বাণীকে ঠিকমতো অনুসরণ করবেন, তারপর তিনি তা মানুষকে শেখান। রাসূল عليه السلام হচ্ছেন জীবন্ত বাণী।
তিলাওয়াহ মানে শুধু আয়াত যেভাবে আরবিতে উচ্চারণ করার কথা, শুধু সেভাবেই উচ্চারণ করা নয়, একইসাথে সঠিকভাবে আয়াত বুঝে নিজের জীবনে অনুসরণ করা। বুঝে, চিন্তা করে, সঠিকভাবে আল্লাহর تعالى বাণী মেনে চলাটা হচ্ছে- তিলাওয়াহ।[১৪] আল্লাহর تعالى বাণীকে আমাদের জীবনে পথপ্রদর্শক হিসেবে নেওয়া হচ্ছে তিলাওয়াহ। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কু’রআন দিয়েছেন শুধুই ‘ইক্বরা’ পড়ার জন্য নয়, তিনি আমাদেরকে কু’রআন সঠিকভাবে ‘তিলাওয়াহ’ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
“তোমাদেরকে পবিত্র করে”
তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধতা দুই ধরনের— ১) বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশুদ্ধতা, ২) চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা। এই দুটোই আমাদের জন্য খুবই জরুরি। যদি আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকে, প্রজ্ঞাও থাকে, কিন্তু চারিত্রিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশুদ্ধতা না থাকে, তাহলে আমরা হয়ে যাবো একজন জ্ঞানী এবং চালাক শয়তান। কারণ ইবলিসের যথেষ্ট জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা ছিল। কিন্তু তার ভেতরে পরিশুদ্ধতা ছিল না।
বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশুদ্ধতা হলো নানা ধরনের ভুল ধারণা, কুসংস্কার, নিজের মতো কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কোনটা মানবো, কোনটা মানবো না —এগুলো থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। যেমন, আমরা হয়ত নিয়মিত কুর’আন পড়ি, হাদিসের বই পড়ি, টিভিতে দিনরাত লেকচার শুনি, কিন্তু ওদিকে সোমবারে মাজারে গিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য মৃত পীর সাহেবের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে আসি।
অথবা, হতে পারে আমরা অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত এবং অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াটা আসলে ওইসব অর্ধ শিক্ষিত রাস্তাঘাটের গরীব লোক, মাদ্রাসার লোকদের জন্য, কারণ তারা আমাদের মতো উচ্চ পর্যায়ের চিন্তা করতে পারে না, আল্লাহকে تعالى গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। যারা বিজ্ঞান, ফিলসফি নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছে, তারা আল্লাহকে تعالى অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারে। তাদের জন্য দিনে পাঁচবার নামাজে উঠবস করার কোনো দরকার নেই।
—এইসব ভয়ংকর ধারণা এবং বিশ্বাস থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। এটা তাযকিয়ার একটি অংশ।
আর চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা হলো- কীভাবে আমরা কথা বলি, মানুষের সাথে ব্যবহার করি, চলাফেরা করি, মেলামেশা করি, অবসর কাটাই, বিনোদন করি ইত্যাদিকে পরিশুদ্ধ করা। যেমন, আমরা হয়ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, যাকাত দেই, ফেইসবুকে সারাদিন ইসলামের উপর পোস্ট পড়ি, পোস্ট করি, কিন্তু ওদিকে বাসায় ফিরে স্ত্রীর সাথে চরম দুর্ব্যবহার করি। স্বামী আর ড্রাইভারের সাথে একই ভাষায় কথা বলি। কে কবে কোথায় কাকে নিয়ে কী বলল — এই নিয়ে ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্যাঁচাতে থাকি। একশ টাকার জিনিস কিনে অফিসে দু’শ টাকার বিল জমা দেই। পিয়নকে বছরে একটাকাও বখশিশ দেই না, কিন্তু পার্টনারকে ঠিকই অফিসের খরচে কক্সবাজারে বেড়াতে যেতে দেই।
—এই সব নোংরামি থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করাটা হবে চারিত্রিক পরিশুদ্ধতা।
যদি আমরা নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ না করি, তাহলে অমুসলিমরা আমাদেরকে দেখবে, আর ভাববে, “ছিঃ! এই হচ্ছে ইসলাম? এরা মনে করে এরা সঠিক পথে আছে, আর আমরা সবাই ভুল পথে আছি? এরা চায় যে, আমরা এদের মতো হই? এরাই আবার বড় গলায় বলে যে, এরা সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে?”
“বিধি-বিধান এবং প্রজ্ঞা শেখায়”
يُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتَٰبَ — ‘তোমাদেরকে কিতাব শেখায়’। কিতাব শব্দটির দুটো মূল অর্থ রয়েছে: ১) যাতে কিছু লেখা আছে, অর্থাৎ বই বা ফলক, ২) বিধিবিধান। এখানে কিতাব বলতে দুটো অর্থই প্রযোজ্য হয়, কারণ রাসূল এসে মানুষকে আল্লাহর تعالى কিতাব শেখান, এবং একই সাথে আল্লাহর تعالى বিধিবিধান শেখান।[১]
এখানে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে يُعَلِّمُكُمُ, যার অর্থ: তোমাদেরকে শেখাবে। এটা أخبر ‘জানানো’ নয়। রাসূল এসে শুধু আল্লাহর تعالى বাণী আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েই চলে যান না, বরং তারা আমাদেরকে শিখিয়ে যান। শেখানো মানে হচ্ছে: প্রথমে কাউকে বিষয়টা বলা, তারপর সেটা যাচাই করা, পরীক্ষা নেওয়া, ভুল হলে সংশোধন করা, বোঝার জন্য সময় দেওয়া। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে: আমরা যখন ইসলামের বাণী প্রচার করছি, একবার বলেই যেন ধরে না নেই: আমাদের দায়িত্ব শেষ। “কুর’আনের আয়াত ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছি। অমুককে রমজানে একটা কুর’আন কিনে দিয়েছি। ব্যাস, আমার কাজ শেষ।” — এতটুকুই আমাদের দায়িত্ব নয়। আমাদের মানুষকে শেখাতে হবে, রাসূলের عليه السلام উত্তরসূরি হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব।
“প্রজ্ঞা শেখাবে” — রাসূল عليه السلام শুধু আমাদেরকে জ্ঞান দেন না, একই সাথে প্রজ্ঞা (হিকমাহ) শেখান। প্রজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞানকে সঠিকভাবে ব্যবহার। আমাদের অনেক জ্ঞান থাকতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞা যদি না থাকে, তাহলে সেই জ্ঞান ঠিকভাবে ব্যবহার হবে না। যেমন: আমরা অনেকেই জানি, আল্লাহ আমাদের ক্বদর/ভাগ্যের মালিক, তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এই ব্যাপারে কুর’আনের আয়াতগুলো আমরা পড়েছি, আমাদের জ্ঞান ঠিকই আছে। কিন্তু তারপরও আমরা বাচ্চার কপালে কালো টিপ দেই, যেন অশুভ চোখ না লাগে। স্বামীর নাম নেওয়া যাবে না, তাতে অমঙ্গল হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পেছনে তাকানো যাবে না, তাতে যাত্রা অশুভ হয়। —এরকম শত শত ভুল ধারণায় আমরা বিশ্বাস করি, কারণ আমাদের জ্ঞান থাকলেও প্রজ্ঞা আসেনি। আমরা শিখিনি আমাদের জ্ঞান কীভাবে কাজে লাগাতে হয়।
অনেকে মনে করেন: নিজে কুর’আন পড়ে বুঝে চললেই হবে। কুর’আন কারও কাছ থেকে শেখার কিছু নেই। সাহাবীরা, তাদের অনুসারীরা কীভাবে কুর’আন বুঝে গেছেন, কীভাবে অনুসরণ করে গেছেন —এগুলো আমাদের জানার কোনো দরকার নেই। আজকের যুগ পাল্টে গেছে। আজকে আমাদেরকে নিজেদের কুর’আন পড়ে, বুঝে, নিজেদের সিদ্ধান্ত মতো জীবনযাপন করতে হবে।
ধরুন, একজন সিদ্ধান্ত নিল যে সে বাজার থেকে সার্জারির উপর বেশ কিছু বই পড়ে নিজেই প্র্যাকটিস করে একজন সার্জন হয়ে যাবে। তার কোনো বড় সার্জনের কাছ থেকে শেখার কোনো দরকার নেই। সে নিজেই পারবে বই পড়ে অপারেশন করতে। সার্জারির উপর যথেষ্ট ভালো বই আছে, বিস্তারিত ছবি দেওয়া আছে, ইউটিউবে আজকাল সার্জারির ভিডিও পর্যন্ত পাওয়া যায়। এত কিছু থাকতে কেন আমাদেরকে কোনো সার্জনের কাছ থেকে সার্জারি করা শিখতে হবে?
একজন বড় সার্জন আমাদেরকে প্রজ্ঞা শেখাবেন। তিনি শেখাবেন কখন কোন পরিস্থিতিতে কী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কখন বইয়ের নিয়ম মানা যাবে, কখন যাবে না। বইয়ের গদবাধা নিয়মের বাইরেও যে অনেক কিছু বিবেচনার আছে, সেগুলো তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখাবেন। সার্জারির আগে রোগীকে কী জানালে, কী না জানালে সার্জারি সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, তা শেখাবেন। সার্জারির পরে কী কী সতর্কতা নিলে ইনফেকশন কম হবে, তা শেখাবেন। এই প্রজ্ঞা বই পড়ে আসে না। এগুলো কারও কাছ থেকে শিখতে হয়, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করতে হয়।
একইভাবে ইসলামের শিক্ষা শুধু কিছু আয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি আয়াতের পেছনে প্রজ্ঞা রয়েছে। কখন কোন প্রেক্ষাপটে কুর’আনের কোন আয়াত প্রযোজ্য, কখন কোন প্রেক্ষাপটে তা প্রযোজ্য নয় —এগুলো আমাদেরকে রাসুলের, তার অনুসারীদের এবং ফিকহ-এ অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শিখতে হবে। না হলে আমরা কুর’আনের আয়াতের আক্ষরিক অনুবাদ করে, পরিস্থিতি বিবেচনা না করে, প্রজ্ঞা ব্যবহার না করে ঝাপিয়ে পড়ব নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে। যার ফলাফল হবে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, এখানে ওখানে বোমাবাজি, খুনাখুনি ইত্যাদি করে ধরে নেওয়া: কুর’আনের আয়াত অনুসারে ইসলামের রাষ্ট্র বাস্তবায়নে জিহাদ করা হয়ে গেল। অথচ দেখা যাবে, কুর’আনের অন্য আয়াত অনুসারে সেগুলো জিহাদ হওয়া তো দূরের কথা, উলটে ফাসাদ হয়ে গেল এবং যারা তা করলেন তারা জিহাদির সন্মানের বদলে ফাসিক হয়ে গেলেন।
যদি কুর’আনের আয়াত শুধু পড়াটাই যথেষ্ট হতো, তাহলে আল্লাহ تعالى শুধু يَتْلُوا۟ ‘তিলাওয়াত করে’ বলেই শেষ করে দিতেন। তিনি এরপর يُعَلِّمُكُمُ ‘তোমাদেরকে শেখাবে’ যোগ করতেন না, এবং ٱلْحِكْمَة ‘প্রজ্ঞা’ উল্লেখ করতেন না। আল্লাহ تعالى এখানে আমাদেরকে বোঝাচ্ছেন যে, মানুষকে ঠিকমতো না শেখালে, বিশেষ করে তাদেরকে প্রজ্ঞা না শেখালে সর্বনাশ হয়ে যায়। একারণে তিনি বিশেষভাবে প্রজ্ঞা শেখানোর কথা বলেছেন।
“আর শেখায় যা তোমরা কখনো জানতে না”
আয়াতের এই অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম যুগের মুসলিমরা উপলব্ধি করেছিল আয়াতের এই অংশটির তাৎপর্য কী। কয়েক বছর আগেও তারা ছিল বিচ্ছিন্ন কিছু দল, যারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি করে বেড়াতো। দুনিয়ার মোহে তারা ছিল অন্ধ। তাদের কোনো বড় লক্ষ্য ছিল না, কোনো জাতীয় মূল্যবোধ, দিকনির্দেশনা ছিল না। ইসলাম আসার আগে আরব গোত্রগুলো ছিল মাস্তান ধরনের এক-একটা দল। অন্যায়, অবিচার, অশ্লীলতা, নোংরামিতে তারা একেবারেই ডুবে ছিল।[৬]
প্রাচীন আরবদের জাহিল বলা হতো, কারণ তারা অনেক বিবেকহীন কাজ করত, যা কোনো সুস্থ চিন্তার মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। যেমন: তারা আল্লাহকে تعالى ‘খুশি’ করার জন্য ‘প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে’ নগ্ন হয়ে কা’বার চারপাশে নাচত। এক সর্বোচ্চ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে تعالى মানার পরেও নানা ধরণের নগ্ন মূর্তির পূজা করত। স্ত্রীকে আর পছন্দ না হলে তাকে ‘মা’-এর সাথে তুলনা দিয়ে (যিহার) নিজের জন্য হারাম বানিয়ে ফেলত। বংশ মর্যাদা বজায় রাখার জন্য মেয়ে শিশু জন্মালে তাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে দেওয়ার মতো ভয়ংকর বিবেকহীন কাজ করত। একারণেই রাসূল মুহাম্মাদ-এর عليه السلام নবুওয়াতের আগের আরবদের যুগকে জাহিলিয়াতের যুগ বলা হতো।
আজকের যুগে ভারতে হিন্দুদের মধ্যে আরবের জাহেলিয়াতের কিছু নমুনা দেখা যায়। ভারতে প্রতি বছর প্রায় ৫০,০০০ মেয়ে ভ্রূণকে গর্ভপাত করে মেরে ফেলা হয়।[২৮৩] আজকাল ভারতের বেশিরভাগ রাষ্ট্রে একারণে জন্ম হওয়ার আগে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে মেয়ে ভ্রূণ মেরে ফেলার কারণে ভারতে ছেলে-মেয়ের সংখ্যায় ভয়ঙ্কর ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে ২ কোটি ২০ লক্ষ নারীর অভাব।[২৮৩] এত বিরাট অঙ্কের পুরুষ বিয়ে করার জন্য ভারতে স্ত্রী খুঁজে পাবে না। এর ফলাফল কী ভয়াবহ হতে পারে তা ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে জঘন্য সব অনৈতিক কাজের খবরাখবর দেখলেই বোঝা যায়।
একইভাবে হাজার বছর ধরে চলে আসা প্রথা অনুসারে ভারতে স্বামী মারা গেলে তার স্ত্রীকে জীবন্ত অবস্থায় স্বামীর মরদেহের সাথে একই সঙ্গে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হতো। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন, সম্রাট আকবর, শাহ জাহান এসে ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর এই জঘন্য প্রথাটিকে বন্ধ করার অনেক চেষ্টা করেন।[২৮৪]
হাজার বছর আগে আরবের জাহেলিয়াতের যুগে নানা ধরনের জঘন্য ঘটনা ঘটছিল। কিন্তু ইসলাম এসে সবকিছুকে পালটে দিয়েছিল। ইসলাম এসে এই সব মাস্তান ধরনের দলগুলোকে ঐক্য, সহমর্মিতা, আদর্শ শেখাল। তাদেরকে অজ্ঞ ও বর্বর জীবন থেকে বের করে এনে, তাদের জীবনে বড় বড় লক্ষ্য এনে দিলো। আল্লাহর تعالى সর্বশেষ বাণীকে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিশনের দায়িত্ব দিলো। রাসূলের عليه السلام সময়ের মুসলিম প্রজন্ম ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, আল্লাহ تعالى এই আয়াতে তাদেরকে কোন্ মহান অনুগ্রহের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।[৬] কী জঘন্য অবস্থা থেকে তাদেরকে বের করে এনে, কী সুন্দর একটা জীবন দিয়েছেন, সেটা যেন তারা উপলব্ধি করে কৃতজ্ঞ হয়।
সূত্র:
- [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার এবং বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর।
- [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
- [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
- [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
- [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
- [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
- [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
- [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
- [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।
- [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি
- [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি
- [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ।
- [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস।
- [১৪] তাফসির আল কুরতুবি।
- [১৫] তাফসির আল জালালাইন।
- [২৮৩] Wikipedia, (2015). Female infanticide in India. [online] Available at: http://en.wikipedia.org/wiki/Female_infanticide_in_India [Accessed 24 Apr. 2015].
- [২৮৪] Wikipedia, (2015). Sati (practice). [online] Available at: http://en.wikipedia.org/wiki/Sati_%28practice%29#Attitudes_of_Muslim_rulers [Accessed 24 Apr. 2015].