কুরআনের কথা

আল্লাহর চেয়ে সুন্দর রঙ আর কে দিতে পারে? — আল-বাক্বারাহ ১৩৮

হাজার বছর ধরে মানুষের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে নানা রঙের নানা ধরনের মাহাত্ম্য বের হয়েছে। হিন্দু ধর্মে লাল পবিত্রতার প্রতীক, তাই বিভিন্ন উৎসবে লাল রঙের ব্যবহার দেখা যায়, যেমন বিয়ে, শিশু জন্ম। হলুদ হচ্ছে জ্ঞান এবং শিক্ষার রঙ, তাই বিষ্ণু এবং গণেশ হলুদ রঙের কাপড় পড়ে। নীল স্থিরতা, সাহসিকতা, একনিষ্ঠতার রঙ, তাই রাম, কৃষ্ণর রঙ নীল।[২৭২]

খ্রিস্টানরা কোনো ব্যক্তিকে খ্রিস্ট ধর্মের দীক্ষা দেওয়ার সময় হলুদ রঙের পানিতে গোসল করায়। একইভাবে নবজাতক শিশুকেও, যে কিনা জন্ম হয়েছে পাপী হয়ে, তাকে হলুদ রঙের পানি দিয়ে ‘বাপটাইজ’ করানো হয়। তখন সে যীশুর জীবন দানের ফলে মানুষের সব পাপ কেটে যাওয়ার দাবীদার হয়ে যায়।[৮]

এভাবে যুগে যুগে নানা ধর্মে, বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন মাহাত্ম্য বের হয়েছে। ধর্মীয় উৎসবগুলোতে নানা রঙের ছড়াছড়ি দেখা যায়।[৮] একইসাথে মুসলিমদের মধ্যে নানা রঙ নিয়ে নানা ধরনের কুসংস্কার চলে এসেছে। কু’রআনে এই সব ফালতু ধারণাকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে—

আমরা আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত। আল্লাহর تعالى চেয়ে সুন্দর রঙ আর কে দিতে পারে? আমরা শুধুমাত্র তাঁরই দাস। [আল-বাক্বারাহ ১৩৮]

অনেকে এই আয়াতের অনুবাদ পড়ে ভাবেন, “আল্লাহর تعالى আবার রঙ আছে নাকি? আস্তাগফিরুল্লাহ! কী সব কুফরি কথাবার্তা!” এই আয়াতে ‘আল্লাহর تعالى রঙ’ বলতে একধরনের প্রতীকী অর্থে বোঝানো হয়েছে। আমরা যেমন বলি “তার হৃদয়ে বসন্তের হাওয়া লেগেছে” তখন কিন্তু আমরা ধরে নেই না যে, তার হৃদপিণ্ডে বসন্তের বাতাস ঢুকেছে। এই কথাটা কেউ গ্রীষ্মকালেও বলতে পারে, আবার শীতকালেও বলতে পারে, এর সাথে বসন্ত ঋতুর কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে এই আয়াতে আক্ষরিক অর্থে কোনো রঙ বোঝানো হয়নি, এটি একটি আরবি প্রবাদ বাক্য। এমনকি যারা কু’রআনে আল্লাহর تعالى সিফাত-এর আক্ষরিক অর্থ করেন, যেমন আল্লাহর تعالى হাত বলতে আক্ষরিক অর্থে হাতই বোঝান, তারাও এই আয়াতে রঙ বলতে আক্ষরিক অর্থে রঙ দাবি করেননি।

এই আয়াতে صِبْغَة বা রঙ-এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। রঙ যেমন দেখলেই সনাক্ত করা যায়, ঠিক একইভাবে যাদের খাঁটি ঈমান রয়েছে, তাদের কথাবার্তা, কাজ, আচরণ দেখলেই তাকে সনাক্ত করা যায়। একজন প্রকৃত মুসলিমকে দেখলেই বোঝা যায় যে, সে আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত।[৪] যদি কোনো মুসলিম-এর কথা-কাজ-আচরণ দেখে কোনোভাবেই বোঝা না যায় যে, সে একজন মুসলিম, তাহলে তার ভেতরে তাওহীদের অভাব রয়েছে। সে এখনো আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত হতে পারেনি।

এই অর্থে এই আয়াতটি একটি নির্দেশ: আল্লাহর تعالى রঙে রঞ্জিত হও। আমাদের জীবনকে ইসলামের রঙে রাঙ্গিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের ভেতরে এবং বাইরে সবকিছুই যেন শুধুমাত্র আল্লাহর تعالى জন্যই হয়। আমরা যেন শুধুমাত্র আল্লাহর تعالى প্রতিই দাসত্ব করি। আমাদেরকে দেখলেই যেন আমাদের বিশেষ রঙের জন্য চেনা যায়। এই রঙ তাওহীদের রঙ।[৪]

আমরা শুধুমাত্র তারই দাস
আয়াতের শেষে আল্লাহ تعالى দেখিয়ে দিচ্ছেন একজন প্রকৃত মুসলিমের কী বলার কথা— وَنَحْنُ لَهُۥ عَٰبِدُون — আমরা শুধুমাত্র তাঁরই দাস, অন্য কারো দাস নই। আগে لَهُۥ দিয়ে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে যে, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহরই تعالى দাসত্ব করি, অন্য কিছু বা কারো দাসত্ব করি না। যদি বলা হতো عَٰبِدُونَ لَهُۥ — আমরা তাঁর দাস — তাহলে আল্লাহর تعالى পাশাপাশি মাঝেমধ্যে অন্য কারো দাস হয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকে যেত।[১]

বেশিরভাগ অনুবাদে আ’বিদুনকে عَٰبِدُونَ ইবাদত বা উপাসনা অনুবাদ করা হয়। সেটি মোটেও আ’বদ-এর প্রকৃত অর্থকে প্রকাশ করে না। আ’বদ عبد অর্থ দাস। আমরা শুধুই আল্লাহর تعالى উপাসনা করি না, আমরা আল্লাহর تعالى দাসত্ব করি। এমনটি নয় যে, আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লাম, রোজা রাখলাম, যাকাত দিলাম –ব্যাস, আল্লাহর تعالى সাথে আমাদের সম্পর্ক শেষ। এরপর আমি যা খুশি তাই করতে পারি। বরং আমরা সবসময় আল্লাহর تعالى দাস। ঘুমের থেকে উঠার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটা কাজে, প্রতিটা কথায় আমাদেরকে মনে রাখতে হবে: আমরা আল্লাহর تعالى দাস এবং আমরা যে কাজটা করছি, যে কথাগুলো বলছি, তাতে আমাদের প্রভু সম্মতি দিবেন কি না এবং প্রভুর কাছে আমি জবাব দিতে পারবো কি না।[১]

এরকম মানুষ দেখেছেন: যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়ে, কিন্তু ব্যাংকের একাউন্ট থেকে সুদ খায়, সুদের লোণ নিয়ে বাড়ি কিনে, কাউকে ভিক্ষা দেবার সময় বা মসজিদে দান করার সময় মানিব্যাগে সবচেয়ে ছোট যে নোটটা আছে, সেটা খোঁজে? বা এরকম মানুষ দেখেছেন: যারা হজ্জ করেছে, বিরাট দাড়ি রেখেছে, কিন্তু বাসায় তার স্ত্রী, সন্তানদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করে? এরা আল্লাহ تعالى আবদ কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, কারণ এরা আল্লাহর ইবাদত বা দাসত্ব করছে না। এরা শুধুই আনুষ্ঠানিক উপাসনা করছে। আনুষ্ঠানিক উপাসনার বাইরে আল্লাহর تعالى প্রতি নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে দিয়ে আল্লাহর আবদ্ হতে এখনও বাকি আছে।

আবার কিছু মানুষ আছে, যারা এখনও আল্লাহর تعالى ইবাদত করা শুরু করতে পারেনি, তারা হল সেই সব মানুষ: যারা ঠিকই নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, যাকাত দেয়, কিন্তু ছেলে মেয়ের বিয়ে দেয় হিন্দুদের বিয়ের রীতি অনুসরন করে গায়ে-হলুদ, বউ-ভাত করে। এরা বাচ্চাদের কপালে কালো টিপ দেয় ‘অশুভ শক্তির’ ভয়ে, যা হিন্দু ধর্মের ধারণা। তারা মসজিদে বা ইসলামিক অনুষ্ঠানে যায় একদম মুসলিম পোশাক পড়ে, হিজাব করে, কিন্তু বন্ধু বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর বাসায় বা বিয়ের অনুষ্ঠানে যায় শরীরের নানা অঙ্গ বের করে, রঙ-বেরঙের সাজসজ্জা করে। —এদের সবার সমস্যা একটি: এরা এখনও আল্লাহকে تعالى প্রভু হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। এদের কাছে “লোকে কী বলবে” বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু “আমার প্রভু কী বলবেন” তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আমরা যখন নিজেদেরকে আল্লাহর تعالى দাস হিসেবে ঘোষণা দিব, তখনই আমরা আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করতে পারবো। যতদিন সেটা করতে না পারছি, ততদিন আমরা “লোকে কী বলবে” এর দাস হয়ে থাকব। ফ্যাশনের দাস হয়ে থাকব। বিনোদন, সংস্কৃতি, সামাজিকতা, কুসংস্কারের দাস হয়ে, নানা ধরনের অমূলক ভয়, আতংক, অস্থিরতার জীবন পার করবো। একমাত্র আল্লাহর تعالى প্রতি একান্তভাবে দাসত্ব করতে পারলেই আমরা এই সব মিথ্যা “প্রভু”দের দাসত্ব থেকে নিজেদেরকে বের করে আনতে পারবো। যারা সেটা করতে পেরেছেন, তারা জানেন এই পৃথিবীতে সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ কত মধুর!

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version