কুরআনের কথা

সে এক জঘন্য যাওয়ার জায়গা — আল-বাক্বারাহ ১২৬-১২৭

ইব্রাহিম বলেছিলেন, “ও আমার প্রভু, এই শহরকে নিরাপদ করে দিন এবং এখানকার অধিবাসীদেরকে ফলমূল-সংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন: যারা আল্লাহ تعالى এবং আখিরাতে বিশ্বাস রাখে তাদের জন্য।” আল্লাহ تعالى বলেছিলেন, “যারা অবিশ্বাস করবে, তাদেরকেও আমি কিছু দিনের জন্য সুখে থাকার ব্যবস্থা করে দেব, তারপর তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তিতে জোর করে ঢোকাবো— সে এক জঘন্য যাওয়ার জায়গা।” [আল-বাক্বারাহ ১২৬]

প্রশ্ন হল: কীসের শহর? নবী ইব্রাহিম عليه السلام যখন কা’বা বানাচ্ছিলেন, তখন তার চারপাশে ধুধু মরুভূমি। শহরের কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু তিনি তার দূরদর্শিতা থেকে ঠিকই বুঝেছিলেন: আল্লাহর تعالى এই ঘরের আশেপাশে একদিন একটা শহর হবে। মানুষ দূর দূর থেকে আসবে এখানে হাজ্জ করতে। তাই তিনি আল্লাহর تعالى কাছে দু’আ করেছিলেন, যেন এখানকার বিশ্বাসী অধিবাসীদের নিরাপত্তা এবং খাওয়ার কোনো অভাব না হয়।

তার দু’আ আল্লাহ تعالى কবুল করেছেন। মক্কায় সারাবছর কোনো ফলের অভাব হয় না। অথচ মক্কায় এবং তার আশেপাশে মরুভূমিতে খেজুর ছাড়া কোনো ফল হয় না। তারপরেও সেখানে গেলে আপনি চায়নার আপেল, মিশরের কমলা, ভারতের কলা —কোনো কিছুর অভাব দেখবেন না। নানা দেশ থেকে সব সুস্বাদু ফল সেখানে সরবরাহ হচ্ছে গত হাজার বছর ধরে।

এছাড়াও সূরা আল-কাসাস ২৮:৫৭-এ বলা আছে: أَوَلَمْ نُمَكِّن لَّهُمْ حَرَمًا ءَامِنًا يُجْبَىٰٓ إِلَيْهِ ثَمَرَٰتُ كُلِّ شَىْءٍ رِّزْقًا مِّن لَّدُنَّا অর্থাৎ সবকিছুর ফল মক্কাতে আসে। এর অর্থ শুধুমাত্র গাছের ফলই নয়, বরং সবকিছুর ফল, সেটা কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে উৎপন্ন পণ্যদ্রব্য সবকিছুই। মক্কাবাসিদের চাষবাস করার কোনো দরকার হয় না। তারা সেই সময়টুকু আল্লাহর تعالى ইবাদতে মনোযোগ দিতে পারেন।[৪]

নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন
নবী ইব্রাহিম عليه السلام মক্কার জন্য আল্লাহর تعالى কাছে নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন চেয়েছিলেন। তার এই দু’আ থেকে তার অসাধারণ প্রজ্ঞার নিদর্শন পাওয়া যায়, কারণ আমরা আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে  সোশালজিতে পড়ি: একটি জাতির উন্নতির জন্য দুটো জিনিস দরকার— ১) নিরাপত্তা, ২) উন্নয়ন। এর একটিও যদি না থাকে, সেই জাতি বেশি দূর যেতে পারে না।[১]

যেমন, একটি দেশে উন্নয়ন থাকতে পারে। হতে পারে সেই দেশে যথেষ্ট খাদ্য তৈরি হচ্ছে, বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। নতুন অফিস, স্কুল-কলেজও হচ্ছে। কিন্তু সে দেশে মানুষের জানমালের যদি কোনো নিরাপত্তা না থাকে, দুর্নীতিগ্রস্থ সরকার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থাকে, সবসময় মারামারি, ভাংচুর, খুন লেগেই থাকে —তাহলে সেই দেশের শিক্ষিত, দক্ষ মানুষগুলো সুযোগ পেলেই অন্য দেশে চলে যাবে, যেখানে তারা নিরাপত্তা পাবে।[১] সবাই প্রথমে নিজের এবং নিজের পরিবারের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। যতই টাকা থাকুক, ঘরের বাইরে বের হলে যদি ছিনতাইকারী, ক্যাডার, খুন, গুম, ধর্ষণের ভয় থাকে, দেশের সরকার যদি জনগণকে জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে সেই মানুষগুলো এক সময় ভাবা শুরু করে, “কী হবে এদেশে থেকে? কীসের জন্য আমি প্রতিদিন নিজের এবং আমার পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নেব? এখানে কামড়ে থাকার মতো আছেটা কী?”

আবার অন্যদিকে কোনো দেশে যদি যথেষ্ট নিরাপত্তা থাকে, শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী থাকে, কিন্তু সেই দেশে কোনো উন্নয়ন না থাকে, যথেষ্ট চাকরির সুযোগ না থাকে, ব্যবসার সুযোগ না থাকে, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের আয় তাদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট না হয়, তাহলে সেই দেশেও মানুষ থাকতে চাইবে না, এবং সেই জাতি বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারবে না। দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারলে, মানুষ একসময় মরিয়া হয়ে উঠবে।[১] গৃহ যুদ্ধ শুরু হবে। দুর্ভিক্ষ হবে। জাতি ধ্বসে যাবে।

যারা আল্লাহ تعالى এবং আখিরাতে বিশ্বাস রাখে
নবী ইব্রাহিম عليه السلام দু’আ করেছিলেন যেন শুধু বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহ تعالى নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন দেন। কিন্তু আল্লাহ تعالى অবিশ্বাসীদের জন্যও তা মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু অবিশ্বাসীদের জন্য এই নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন হবে তাদের জাহান্নামে যাওয়ার পাথেয়। তারা বিপুল পরিমাণের সম্পত্তির মালিক হবে, সোনা দিয়ে লেপা মার্সিডিজ গাড়ি, বিশাল ব্যক্তিগত দোতলা প্লেন, মাইলের পর মাইল গাড়ির বহর, আকাশচুম্বী সব বিল্ডিং-এর মালিক হবে। কিন্তু এগুলো সব তাদেরকে বিলাসিতায় ডুবিয়ে রাখবে, আল্লাহ تعالى এবং আখিরাত থেকে ভুলিয়ে রাখবে। তারপর কিয়ামতের দিন তাদেরকে পশুর মতো তাড়িয়ে নিয়ে জাহান্নামের হিংস্র আগুনে ছুঁড়ে ফেলা হবে।

নবী ইব্রাহিমের عليه السلام দু’আ
নবী ইব্রাহিম যখন কা’বা তৈরি শেষ করলেন, তিনি এবং তার সন্তান ইসমাইল দু’আ করলেন—

ইব্রাহিম এবং ইসমাইল যখন কা’বার ভিত্তি তৈরি করছিলেন, “ও আমাদের প্রভু, আমাদের কাছ থেকে এটি গ্রহণ করুণ। আপনি তো সব শোনেন, সব জানেন।” [আল-বাক্বারাহ ১২৭]

এখন প্রশ্ন আসে, কা’বা তৈরি করার সময় নবী ইব্রাহিম عليه السلام কেন দু’আ করছিলেন, যেন তাদের তৈরি কা’বা আল্লাহ تعالى গ্রহণ করে নেন? তারা কি আল্লাহর تعالى আদেশই অনুসরণ করছিলেন না? এখানে গ্রহণ না করার মতো কী কারণ থাকতে পারে?

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে শেখাচ্ছেন: আমরা যদিও আল্লাহর تعالى নির্দেশ অনুসারে নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, যাকাত দেই —কিন্তু এগুলো আল্লাহ تعالى গ্রহণ নাও করতে পারেন, কারণ, আল্লাহর تعالى হুকুম পালনে আমাদের যথেষ্ট ত্রুটি থাকতে পারে। নামাজ পড়েই আমরা যেন ধরে না নেই, “ব্যাস, আমার আজকের সব ফরজ দায়িত্ব শেষ। ফেরেশতারা, তোমরা চলে এসো, আমি জান্নাতে যাওয়ার জন্য তৈরি।” রমজানে ৩০ রোজা রেখে যেন না ভাবি, “আমি এখন শিশুর মতো পবিত্র। আমার জান্নাতে যাওয়া আর ঠেকায় কে?” ফেইসবুকে ইসলামের উপরে পোস্ট দিয়ে হাজার খানেক লাইক পেয়ে যেন না ভাবি, “১০০০ লাইক x ৭০ নেকি = ৭০,০০০ নেকি। চমৎকার! জান্নাতুল ফেরদাউস পর্যন্ত পৌঁছাতে আর মাত্র ৩০০ লাইক দরকার।”

আমরা একটা মসজিদ দিতে পারলে ভাবি: এই মসজিদে যত মানুষ নামাজ পড়বে, তার সওয়াবের অংশীদার হবো আমি। কিয়ামতের দিন আমার নেকির পাল্লা এত ভারি হবে যে, তা তোলার জন্য কয়েকজন ফেরেশতা লাগবে। আর এখানে নবী ইব্রাহিম عليه السلام তৈরি করছেন কা’বা! এই কা’বায় প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হাজি ইবাদত করতে আসেন। হাজার বছর ধরে কত কোটি কোটি মানুষের ইবাদত হয়েছে এই কা’বা ঘিরে। তিনি যদি কা’বায় আসা প্রত্যেক মানুষের ইবাদতের সওয়াবের অংশীদার হন, তাহলে তিনি কী পরিমাণ সওয়াব পাবেন এই কা’বা থেকে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আর তিনিই আল্লাহর تعالى কাছে ভিক্ষা চাইছেন, যেন তার এই চেষ্টা আল্লাহ تعالى কবুল করে নেন!

আল্লাহ تعالى যদি অনুগ্রহ করে আমাদের ইবাদতগুলো কবুল করে না নেন, তাহলে সর্বনাশ! আমাদের একটা নামাজও কবুল হবে না, কারণ নামাজে দাঁড়িয়ে এমন কোনো চিন্তা নেই, যা আমরা করি না। আমাদের রোজা কবুল হবে না, কারণ রোজা রেখে আমরা মিথ্যা বলি, গীবত করি, অন্যের উপর অন্যায় করি, নিজের সুবিধার জন্য টাকা এদিক ওদিক করি, হিন্দি সিরিয়াল দেখি। আমাদের যাকাত কবুল হবে না, কারণ যাকাত দেওয়ার সময় আমরা যতভাবে সম্ভব কম সম্পত্তির হিসেব করে, যাদেরকে যাকাত দিলে বেশি নাম হবে, তাদেরকে দেই। আমাদের হাজ্জ কবুল হবে না, কারণ হাজ্জের টাকায় মিশে আছে ব্যাঙ্কের সুদ, মামা-চাচা-খালু ধরে অন্যায়ভাবে জোগাড় করা চাকরি বা ব্যবসার আয়।

একারণে আমাদের প্রতিটি ইবাদতের পরে আল্লাহর تعالى কাছে ভিক্ষা চাইতে হবে, যেন তিনি অনুগ্রহ করে তা গ্রহণ করে নেন। নবী ইব্রাহিম عليه السلام যেভাবে আকুলভাবে আল্লাহকে تعالى অনুরোধ করেছিলেন, “আপনি তো সব শোনেন” —ঠিক একইভাবে আমাদেরকেও আল্লাহর تعالى কাছে অনুরোধ করতে হবে, যেন তিনি আমাদের আকুল অনুরোধ শোনেন। “আপনি তো সব জানেন” —শত ভুলত্রুটি, দুর্বলতার পরেও আমাদের চেষ্টাকে তাঁর تعالى অসীম রহমতে বিবেচনা করেন। নবী ইব্রাহিম-এর عليه السلام মতো একজন নবী যদি কা’বা-র মতো বিরাট সন্মানের স্থাপনা বানিয়ে আল্লাহর تعالى কাছে সেটা গ্রহণ করার জন্য ভিক্ষা চাইতে পারেন, তাহলে আমরা কোথাকার কে?

এই আয়াতে বাবা-মাদের জন্য একটা শেখার ব্যাপার আছে: নবী ইব্রাহিম عليه السلام দু’আ করেছিলেন তার ছেলেকে সাথে নিয়ে। তিনি কা’বা তৈরি করেছেন ছেলেকে সাথে নিয়ে। আমরা অনেকেই নিজেরা ইসলামের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস হলেও, আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে ইসলামের কাজে খুব একটা লাগাই না। তাদেরকে সাথে নিয়ে ইবাদত করি না। অনেকে আছেন যারা সারাদিন অফিস করে এসেই চলে যান মসজিদে, হালাক্বায়: ইসলামের কাজে অংশ নিতে। অথচ এদিকে ঘরে তার ছেলে সারাদিন ভিডিও গেম খেলছে, মেয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। অনেকে নিজেরা মসজিদে, রাস্তাঘাটে কষ্ট করে ইসলামের জন্য কাজ করলেও, তাদের আদরের দুলালদেরকে ঘরে বসে নামাজ-কুরআন পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। আবার অনেক মা নিজেরা হিজাব করলেও দেখা যায় তার কিশোরী-তরুণী মেয়ে হালের ফ্যাশনে গা ভাসিয়ে তারই সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

নবী ইব্রাহিম-এর عليه السلام কাছ থেকে আমাদের সবার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়ার আছে: নিজে ইসলামের জন্য কাজ করলেই হবে না, একইসাথে সন্তানদেরকেও সাথে নিয়ে ইসলামের জন্য কাজ করতে হবে। এর ফলে সন্তান যেমন জীবনের বাস্তবতা বাবা-মার কাছ থেকে শিখবে, একইসাথে সন্তান সুযোগ পাবে কিছু ভালো সময় তার বাবা-মার সাথে কাটানোর। একসাথে কাটানো এই সুন্দর সময়গুলো তাদের সারাজীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। বাবা-মা যদি সত্যিই চান জান্নাতে গিয়ে সন্তানদের সাথে অনন্ত সুখ উপভোগ করতে, তাহলে তাদের এই জীবন থেকেই সন্তানদেরকে সাথে নিয়ে জান্নাতের জন্য কাজ শুরু করা উচিত।

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version