যিনি মানুষকে এক ঝুলন্ত গঠন থেকে সৃষ্টি করেছেন
আল্লাহ تعالى মানুষকে লক্ষ্য করতে বলছেন এক বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন আলাক্ব অর্থাৎ জমাট বাঁধা রক্ত বা ঝুলন্ত এক গঠন থেকে। এই বাণী যখন মানুষকে দেওয়া হয়েছিল, তখন মানুষ জানত না এই আয়াতের গভীরতা কতখানি। আজকে আমরা অত্যাধুনিক স্ক্যানিং প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখতে পেয়েছি ভ্রূণ মায়ের গর্ভের দেওয়ালে আঁকড়ে ধরে ঝুলে থাকে। আর আলাক্ব শব্দের অর্থই হচ্ছে এমন একটা কিছু, যা আঁকড়ে ধরে ঝুলে থাকে।
আল্লাহ تعالى যখন মানুষকে তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে বলেন, তখন তার মধ্যে কিছু উদ্দেশ্য থাকে। প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহর تعالى অসীম ক্ষমতা, সৃজনশীলতা এবং তাঁর প্রজ্ঞা সম্পর্কে মানুষকে চিন্তা করতে উৎসাহ দেওয়া। একটা মাত্র জমাট বাঁধা রক্ত থেকে একসময় চোখ, মুখ, কান, হাত, পা বের হয়ে বড় সড় একটা পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি হয়ে যায়। জমাট বাধা রক্তের মধ্যে কোনো বিবেক, বুদ্ধি, চেতনা কিছুই নেই। এটা একটা বোধ শক্তিহীন জড় পদার্থ। অথচ এই রক্তের ফোঁটা থেকেই মহাবিশ্বের অন্যতম বুদ্ধিমান, চেতন, বিবেকবান, জটিল প্রাণীর জন্ম হয়। কীভাবে এক ফোঁটা রক্তের মধ্যে এত বিপুল পরিমাণের তথ্য থাকে যে, তা মানুষের প্রতিটি অঙ্গের আকৃতি, গঠন, চামড়ার রঙ, চোখের রঙ, উচ্চতা, শারীরিক ক্ষমতা, মস্তিষ্কের মতো জটিলতম যন্ত্র গঠন করার যাবতীয় নির্দেশ সংরক্ষণ করা থাকে?
আজকে আমরা জানতে পেরেছি: মানুষের ডিএনএ-র মধ্যে আল্লাহ تعالى লিখে দিয়েছেন কীভাবে মানুষের দেহকে বানাতে হবে। এগুলোর মধ্যে তিন শত কোটি নির্দেশ লেখা রয়েছে। এই নির্দেশগুলো বলে দেয় কীভাবে চোখ, হাত, পা, মাথা, দেহের ভেতরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবকিছু বানাতে হবে। কোনটার কী আকৃতি হবে, কী রঙের হবে, কী কাজ করবে। কোনটায় কী সমস্যা থাকবে। কোনটা কখন বিকল হয়ে যাবে। মানুষের শরীরের কয়েক লক্ষ কোটি কোষ কোথায় কোন জায়গায় বসবে, কীভাবে কাজ করবে, এই সবকিছু বলা থাকে ডিএনএ-তে।
এই তিন শত কোটি নির্দেশ বই আকারে ছাপালে ১৩০ খণ্ডের বই হয়, যা পড়তে মানুষের প্রায় ৯৫ বছর লাগবে। এই বিশাল নির্দেশমালা আল্লাহ সংরক্ষণ করছেন ক্রোমোজোম নামের এমন ক্ষুদ্র একটি ব্যবস্থায়, যা খালি চোখে দেখা তো যা-ই না, সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যায় না, বিশেষ শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে। আর এই ক্রোমোজোমগুলো, যা কিনা ১৩০ খণ্ডের বইয়ের সমান, হুবহু একইভাবে রাখা আছে দেহের প্রতিটি কোষে। আমাদের দেহে কয়েক লক্ষ কোটি কোষের প্রত্যেকটির মধ্যে ঠিক একইভাবে তিন শত কোটি নির্দেশ লেখা আছে।
মানুষ যদি সময় নিয়ে এই পদ্ধতিটির পেছনে কত বিস্ময়, কত রহস্য আছে তা ভেবে দেখে, তাহলে তারা আল্লাহর تعالى ক্ষমতা, সৃজনশীলতার অসাধারণ সব নিদর্শন খুঁজে পাবে। দ্বিতীয়ত, মানুষকে তার অবস্থান পরিষ্কার করে দেওয়া। মানুষ যখন নিজেকে বড় কিছু মনে করে, দম্ভ করে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, নিজেকে কোনো ঊর্ধ্বতন ক্ষমতার অধীনে মানতে অস্বীকার করে, তখন সে যেন চিন্তা করে দেখে তার শুরুটা কী নগণ্য একটা ব্যাপার ছিল। একটা মাত্র রক্তের পিণ্ড থেকে সে শুরু হয়েছিল। কত তুচ্ছ, দুর্বল একটা সৃষ্টি।
পড়ো! তোমার প্রতিপালক বড়ই মহানুভব
আল্লাহ تعالى মানবজাতিকে পড়ার ক্ষমতা দিয়ে তাদের প্রতি অনেক দয়া এবং করুণা দেখিয়েছেন। আর কোনো প্রাণী তিনি সৃষ্টি করেননি যারা পড়তে পারে। যদিও অন্যান্য প্রাণীরা কিছু কাজ মানুষের থেকে অনেক ভালো ভাবে করতে পারে। যেমন, কিছু পাখি মানুষের থেকে অনেক ভালো ভাবে দেখে। কিছু প্রাণীর শারীরিক শক্তি মানুষের থেকে অনেক বেশি। এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু মানুষকে আল্লাহ تعالى সৃষ্টি করেছেন এমনভাবে, যেন সে জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং জ্ঞানের বিকাশ করতে পারে। মানুষকে তিনি কোনো কিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করার ক্ষমতা দিয়েছেন। গণিতের ব্যবহার শিখিয়েছেন। সৃজনশীল কল্পনা করার ক্ষমতা দিয়েছেন। এইসব গুণের কারণেই মানুষ পশুর পর্যায় থেকে উপরে উঠে উন্নত জীব হয়ে আজকে সব পশুর উপর কর্তৃত্ব করছে। যদি আল্লাহ تعالى মানুষকে না শেখাতেন, তাহলে মানুষ পশুর মতো শুধুই জৈবিক চাহিদা মিটিয়ে জীবনটা শেষ করতো।
তিনি কলমের মাধ্যমে শিখিয়েছেন। তিনি মানবজাতিকে শিখিয়েছেন, যা তারা জানত না
আল্লাহ تعالى মানুষকে শিখিয়েছেন? আমি তো শিখেছি আমার বাবা-মার কাছ থেকে? তাহলে আল্লাহ تعالى আমাকে শিখালেন কীভাবে?
আমার বাবা-মাকে কে শিখিয়েছে? তাদেরকে যে শিখিয়েছে, তাকে কে শিখিয়েছে? একদম প্রথম মানুষকে কে শিখিয়েছে? — এভাবে পেছন দিকে গেলে আমরা দেখতে পাই, মানবজাতিকে আল্লাহ تعالى প্রথম লেখা শিখিয়েছেন। তিনি تعالى অন্য কোনো প্রাণীকে তা শেখাননি।
কোনো জাতি যখন লিখতে পারে না, তখন তার অবস্থা থাকে করুণ। লিখতে না পারার কারণে ভাবের আদান-প্রদান সীমিত হয়ে যায়। জ্ঞানের প্রচার খুবই সীমাবদ্ধ থাকে। মুখে-মুখে যেটুকু তথ্য আদান প্রদান করা যায়, সেটা নিয়েই কাজ চালাতে হয়। এছাড়াও মানুষের স্মৃতি দুর্বল। সে সবকিছু মনে রাখতে পারে না এবং যাও বা মনে রাখতে পারে, সেটাতে অনেক সময় ভুল হয়। লিখতে পারলে এই ভুল এড়ানো যায়। লিখতে না পারলে সাহিত্যের প্রসার এবং প্রচার সীমিত থাকে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, যে জাতিগুলো লিখতে পারত না, যারা তাদের সাহিত্য, জ্ঞান, সংস্কৃতি লিখে সংরক্ষণ করে রেখে যেতে পারেনি, তাদেরকে মানুষ ভুলে গেছে। আর যারা লিখতে পারত, তাদের জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, সংস্কৃতি লিখে সংরক্ষণ করে রেখে গেছে, তাদেরকে আমরা হাজার বছর পরেও মনে রেখেছি। একারণেই লিখতে পারাটা একটা বিরাট অর্জন। আর এই অর্জন একমাত্র আল্লাহর تعالى কৃতিত্ব। তিনিই تعالى মানুষকে লেখার ক্ষমতা দিয়েছেন। বানর, শিম্পাঞ্জি, অক্টোপাস অনেক জটিল কাজ করতে পারলেও লিখতে পারে না। লিখে মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা শুধুমাত্র মানুষের রয়েছে।
লেখা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, সূরাহ বাকারাহ’তে নির্দিষ্ট মেয়াদের ঋণ দেওয়ার সময় তা তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে লিখিয়ে রাখতে আল্লাহ تعالى আদেশ দিয়েছেন। চুক্তি লিখে না রাখলে মানুষের মধ্যে সমস্যা তৈরি হয়। ঝগড়া, বিবাদ থেকে মারামারি, হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। এসব কিছুই এড়ানো যায় লেখার মাধ্যমে।
অথচ মানুষ এমনভাবে প্রকাশ্যে অবাধ্যতা করে, যেন সে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেখানে কিনা সে তোমার প্রভুর কাছে একদিন ফিরে যাবেই
আমরা যদি তিন ধরণের মানুষের দিকে দেখি: ১) নাস্তিক, ২) মুসলিম নামধারী শয়তান এবং ৩) নামে মুসলিম, কাজে যে কী, সে নিজেও জানে না—এদের সবার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো: এরা মনে করে এরা নিজেরাই যথেষ্ট নিজের ভালোমন্দ বোঝার জন্য। এদের মাথার উপরে কেউ আছেন, যার কথা তাকে মানতে হবে, এটা তারা মানবে না। একদিন যে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে সব কাজের জবাব দিতে হবে, এটা তারা মেনে নেবে না। এরা অফিসের বস, পাড়ার ‘বড় ভাই’, রেস্টুরেন্ট নিয়মিত খাওয়ানো দোস্ত —এদের কথামতো উঠবস করতে পারে, কিন্তু আল্লাহর تعالى সামনে পারে না। কারণ তাদের যাবতীয় আমোদ-ফুর্তির মাঝখানে আল্লাহ تعالى বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। তাঁকে تعالى সরিয়ে দিতে পারলে আর বিবেকের দংশনে পুড়তে হয় না।
আল্লাহ تعالى মানুষকে জ্ঞান দিলেন, পড়া এবং লেখা শেখালেন। তারপর মানুষ এর বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা দেখানো তো দূরের কথা, বরং তার জ্ঞান, বিজ্ঞান, বুদ্ধি ব্যবহার করে কীভাবে আল্লাহর تعالى অবাধ্য হওয়া যায়, তার চেষ্টা করা শুরু করলো। যেই জ্ঞান আল্লাহকে تعالى উপলব্ধি করতে সাহায্য করার কথা, সেই জ্ঞান মানুষ নিজের কামনা-বাসনা পূরণ করার জন্য কাজে লাগিয়ে আল্লাহকেই تعالى অস্বীকার করে বসলো। যেই পড়া এবং লেখার ক্ষমতা মানুষের ব্যবহার করার কথা ছিল আল্লাহকে تعالى জানা এবং জানানোর জন্য, সেই পড়া এবং লেখার ক্ষমতা ব্যবহার করে মানুষ আল্লাহর تعالى বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করলো। —এই সবের মূল কারণ একটাই: মানুষ মনে করে সে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার কোনো সৃষ্টিকর্তার দরকার নেই।
তুমি কি তাকে দেখেছ, যে আমার বান্দাকে নামাজ পড়তে মানা করে?
চৌধুরী সাহেব বলেন, “ভাই, নামাজ-টামাজ হচ্ছে অর্ধশিক্ষিত মানুষদের জন্য। যাদের চিন্তা ভাবনা সফিস্টিকেটেড না, যারা বিজ্ঞান নিয়ে বেশি পড়াশুনা করেনি, সৃষ্টিকর্তার সম্পর্কে ধারনা গভীর না, তাদের জন্যই নামাজ। আমাদের নামাজ পড়া লাগে না। আমরা সৃষ্টির রহস্য আপনাদের থেকে ভালো বুঝতে পারি।” —এরা হচ্ছে পরোক্ষভাবে মানুষকে নামাজ পড়তে নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা নামাজ পড়তে মানুষকে রীতিমত বাঁধা দেয়। সুযোগ পেলে মুসলিমদের উপর অত্যাচার করে।
আল্লাহ تعالى এবং তার বান্দার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে বান্দা যখন নামাজ পড়ে। যারা এই কাজে বাঁধা দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখায়, তারা ভয়ংকর অপরাধী। এদেরকে আল্লাহ تعالى চ্যালেঞ্জ করছেন—
সে কি নিজে সঠিক পথে আছে? সে কি আল্লাহর প্রতি সাবধান হতে বলে? সে কি নিজে অস্বীকার করে না? মুখ ফিরিয়ে নেয় না? সে কি জানে না যে, আল্লাহ সব দেখেন?
যারা মানুষকে নামাজ পড়তে নিরুৎসাহিত করে, বাঁধা দেয়, তাদেরকে আল্লাহ تعالى প্রশ্ন করছেন, “সে নিজে কী সঠিক পথে আছে?” — চৌধুরী সাহেব টাইপের মানুষরা ভেতরে ভেতরে ঠিকই জানে যে, তাদের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা, ধ্যানধারনা হচ্ছে কীভাবে নিজের আমোদ ফুর্তি ঠিক রাখা যায়। তারা সবসময় চেষ্টা করছে কীভাবে তারা তাদের লাইফস্টাইল ধরে রাখতে পারে। সেজন্য তারা ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের যুক্তি-তর্ক দাঁড় করায়। তাদের ফিলসফি হচ্ছে—“আমি আমার প্রভু, আমি কারও কথা শুনতে বাধ্য নই”।
এখানে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, এরা তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহর تعالى প্রতি সাবধান হতে বলে না। কেন আল্লাহ تعالى তাকওয়া-কে উল্লেখ করলেন এই ধরণের মানুষদের সরূপ বোঝানোর জন্য, তা বুঝতে হলে আমাদের তাকওয়া শব্দের অর্থ বুঝতে হবে।
তাকওয়া শব্দটির অর্থ সাধারণত করা হয়—আল্লাহকে ভয় করা। এটি পুরোপুরি সঠিক অনুবাদ নয়, কারণ ‘ভয়’ এর জন্য আরবিতে ভিন্ন শব্দ রয়েছে—যেমন খাওফ خوف, খাশিয়া خشي, হিযর حذر; শুধু কু’রআনেই ১২টি আলাদা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন গভীরতার ভয়, সতর্কতা, আতঙ্ক ইত্যাদি তুলে ধরার জন্য। এর মধ্যে ‘তাক্বওয়া’ হচ্ছে ‘সবসময় পূর্ণ সচেতন’ থাকা বা আল্লাহর কথা মনে রেখে নিজেকে অন্যায় থেকে দূরে রাখা।[১][২]
ধরুন, আপনি প্রতিদিন কী করেন, সেটা নিয়ে একটা ‘রিয়েলিটি টিভি শো’ বানানো হচ্ছে। আপনার বাসার সবগুলো রুমে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আপনি ঘুম থেকে ওঠার পর ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সবসময় আপনার সাথে একজন ক্যামেরাম্যান আপনার দিকে ক্যামেরা তাক করে রেখেছে। আপনি কী বলছেন, কী করছেন, কী খাচ্ছেন, কী দেখছেন, সবকিছু প্রতি মুহূর্তে রেকর্ড করা হচ্ছে। কল্পনা করুন, যদি এরকম কোনো ঘটনা ঘটে তাহলে আপনার মানসিক অবস্থা কী হবে? আপনি প্রতিটা কথা বলার আগে চিন্তা করবেন যে, আপনার কথাগুলো মার্জিত হচ্ছে কি না, আপনার হাঁটার ধরন ঠিক আছে কি না, আপনি উল্টোপাল্টা দিকে তাকালে সেটা আবার রেকর্ড হয়ে গেলো কি না। আপনি টিভিতে যেসব হিন্দি সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, মুভি দেখেন, যেসব গান শুনেন, ইন্টারনেটে যে সব সাইট ঘুরে বেড়ান, সেগুলো ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে গেলে লোকজনের কাছে মান-সন্মান থাকবে কি না। এই যে ক্যামেরাম্যানের প্রতি আপনার চরম সচেতনতা, এটাই তাকওয়া। আল্লাহর تعالى প্রতি আপনার ঠিক একই ধরনের সচেতনতা থাকার কথা।
মানুষ যখন আল্লাহর تعالى প্রতি এই ধরণের সচেতনতা আনতে পারে, তখন তার জন্য অপরাধ করা কঠিন হয়ে যায়। কারণ সে সবসময় খেয়াল রাখে যে, আল্লাহ تعالى তার কাজ দেখছেন, তার কথা শুনছেন, এমনকি তার চিন্তাগুলোও জানতে পারছেন। একারণেই কুর‘আনে তাকওয়া’র প্রতি এত জোর দেওয়া হয়েছে, কারণ মানুষকে অন্যায় থেকে দূরে রাখার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়া দুর্বল থাকলে একজন মানুষের টুপি-দাঁড়ি-বোরকা থাকুক, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুক না কেন, যখন তখন তার ভেতরকার পশুটা সুযোগ পেলেই বের হয়ে আসে।
যারা মানুষকে ইসলাম থেকে সরে যেতে বলে, ইসলামে প্রবেশ করতে বাঁধা দেয়, তারা সবার আগে মানুষের ভেতর থেকে তাকওয়া দূর করতে বলে। কারণ তাকওয়া থাকলে জীবনের যাবতীয় আমোদ, ফুর্তি, কামনা, বাসনা পূরণ করা কঠিন হয়ে যায়। মানুষের ভেতরে তাকওয়া থাকলে তাদেরকে দিয়ে আর নিজেদের উদ্দেশ্যমতো কাজ করানো যায় না। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা কঠিন হয়ে যায়। অবৈধ ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যায়। নিজেরা অন্যায়ে বুঁদ হয়ে থাকতে বাঁধা চলে আসে। নিজেদের পছন্দের সংস্কৃতি, ধর্ম প্রচার করা যায় না। আস্তে আস্তে আল্লাহর تعالى প্রতি নিবেদিত মানুষরা স্বাধীন হয়ে যেতে থাকে। তাদেরকে আর সংস্কৃতি, অন্ধ বিশ্বাস, অবৈধ ক্ষমতার আনুগত্যের মধ্যে আটকে রাখা যায় না।
খবরদার! সে যদি এসব বন্ধ না করে, তাহলে আমরা তার মাথার সামনের চুলের ঝুঁটি ধরে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবো। মিথ্যাবাদী, পাপী মাথার সামনের ঝুঁটি। ডাকুক সে তার সাঙ্গপাঙ্গদের। আমি জাহান্নামের পাহারাদারদের ডাকবো।
যারা মানুষকে ইসলামের পথে চলতে বাঁধা দেয়, নামাজ পড়তে বাঁধা দেয়, তাদের পরিণতি হবে করুণ। এরা দুনিয়াতে যতই দলবল নিয়ে থাকুক না কেন, আখিরাতে এদেরকে চরম অপমানিত করে মাথার চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
এই আয়াতগুলোর ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। রাসুল عليه السلام যখন প্রথম কা’বা’র সামনে গিয়ে নামাজ পড়তে শুরু করলেন, তখন আবু জাহিল তা সহ্য করতে পারল না। তার মতো একজন শক্তিশালী নেতার কথার অবাধ্য হয়ে, সবাইকে দেখিয়ে রাসুল عليه السلام নিজের মতো ধর্ম অনুসরণ করছেন, তাও আবার কা’বার সামনে, সেটা সে মেনে নিতে পারল না। সে ঘোষণা দিলো যে, যদি সে রাসুলকে عليه السلام কা’বার সামনে নামাজ পড়তে দেখে, তাকে সিজদা করা অবস্থায় পায়, তাহলে সে রাসুলের ঘাড়ে পা দিয়ে পিষে দেবে। তার এই ঔদ্ধত্যের জবাবে এই আয়াতগুলো আসে। রাসুল عليه السلام তিলাওয়াত করতে থাকেন— “খবরদার! সে যদি এসব বন্ধ না করে, তাহলে আমরা তার মাথার সামনের চুলের ঝুঁটি ধরে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবো। মিথ্যাবাদী, পাপী মাথার সামনের ঝুঁটি। ডাকুক সে তার সাঙ্গপাঙ্গদের। আমি জাহান্নামের পাহারাদারদের ডাকবো।”
রাসুল عليه السلام একা এই কথাগুলো বলছেন। ওদিকে আবু জাহিল এক বিরাট নেতা, তার বিশাল দলবল। তার কথামত মক্কার লোকজন ওঠাবসা করে। এরকম একজন মাফিয়া গডফাদারের মুখের সামনে একজন নিরীহ মানুষ এই সব হুমকি দিচ্ছে, এটা একটা বিরাট ব্যাপার। কেউ এত শক্তিশালী একজন মানুষকে এত বড় হুমকি দেওয়ার কথা চিন্তাও করবে না, যদি না সে তার হুমকির সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়। এই হুমকি প্রমাণ করে দেয় আল্লাহর تعالى বাণী সত্য। কারণ আবু জাহিল যদি রাসুলের عليه السلام ঘাড়ে পা রাখতো, তারপর তার কিছুই না হতো, তাহলে রাসুল عليه السلام ভুল প্রমাণ হয়ে যেতেন। ইসলামের প্রচার শেখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু আবু জাহিল পারেনি। সে এগিয়ে গেলেও এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখে সে ভয়ে ফিরে আসে।[৪][৮][১৭][১৮]
আল্লাহ تعالى কেন জাহান্নামের পাহারাদের কথা বললেন? অন্য কোনো ফেরেশতাদের কথা বললেন না? জাহান্নাম সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গা। সেখানে যারা থাকে, স্বাভাবিকভাবেই তারা হবে প্রচণ্ড শক্তিশালী, কঠিন, নিষ্ঠুর সৃষ্টি। এদেরকে বানানোই হয়েছে পাপী মানুষ এবং জিনদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করার জন্য। এদের মধ্যে কোনো ধরণের দয়া-মায়া থাকার কথা নয়। এরা হবে ভয়ংকর রকমের হিংস্র। আল্লাহ تعالى এই হিন্স্রতম, নিষ্ঠুরতম, শক্তিশালী বাহিনীকে ডাকবেন আবু জাহিল এবং তার মাফিয়া বাহিনীর মোকাবেলায়। কোনো মানুষের ক্ষমতা নেই আল্লাহর تعالى এই বিশেষ বাহিনীর সামনে মুহূর্তের জন্যও টিকে থাকার।
না! ওর কথামত চলবে না। আমাকে সিজদা করো, আমার আরও কাছে আসো।
আবু জাহিল এর কথায় পাত্তা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। রাসুল যেন নিশ্চিত মনে আল্লাহর تعالى সামনে সিজদা করেন। আল্লাহর تعالى প্রতি আরও নিবেদিত হয়ে ইবাদত করেন। এই আয়াতে আজকের যুগের মুসলিমদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে।
ইসলামের পথে যতই বাঁধা আসুক, রাজনৈতিকভাবে আমরা যতই সমস্যার মধ্যে থাকি না কেন, অন্য কারও কথায় আমাদের ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা নিশ্চিন্ত মনে আল্লাহর تعالى সামনে মাথা নত করবো, তাঁর تعالى আরও কাছে যাবো। প্রতিটি সমস্যা, প্রতিটি বাঁধা যেন আমাদের ঈমানকে আরও গভীর করে দেয়। আমরা যেন আল্লাহর تعالى আনুগত্যে আরও শক্তিশালী হই। কারণ যে সব বান্দারা শত সমস্যা এবং বাঁধার মধ্যেও ইসলাম মেনে চলেন, তারা বড়ই সম্মানিত মুসলিম। তাদের জন্য বিশাল পুরস্কার আল্লাহ تعالى তাঁর নিজের কাছে রেখেছেন।
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্শাফ।