কুরআনের কথা

ওদের বিশ্বাস একেবারেই নগণ্য পর্যায়ের — আল-বাক্বারাহ ৮৮-৯১

আপনি পাড়ার কলেজের শিক্ষক মীর-জাফর সাহেবকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছেন, “ভাই, কিছু চরমপন্থি দলের উল্টোপাল্টা কাজকর্মকে ইসলামের শিক্ষা বলে প্রচার করে ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন, এটা তো অন্যায়। চেতনার নাম করে কিশোর-তরুণদের উত্তেজনার ড্রাগ দিয়ে, তাদেরকে রাজনৈতিক নেতাদের হাতের পুতুল বানাচ্ছেন, এটা কি একটা বিরাট প্রতারণা নয়? পাবলিসিটির লোভে আপনি মানুষকে অহেতুক ফুসলিয়ে, তাদেরকে সস্তা আবেগের খোরাক দিচ্ছেন, আল্লাহর تعالى কাছে এসবের জবাব কীভাবে দেবেন?”

কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। তার উত্তর, “ভাই, আমাকে এইসব ফালতু নীতিকথা বলে লাভ নেই। আমি একজন বিদেশ থেকে পিএইচডি করা শিক্ষিত মানুষ। আমি জানি আমি যা করছি সেটা ঠিক কাজ। আমাকে এই সব সব হাজার বছরের পুরনো আরব কেচ্ছা কাহিনী শুনিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি কোনো গ্রামের অর্ধশিক্ষিত লোক না যে, আপনার এই সব শাস্তির কথা শুনে ভয় পাব। আপনি অন্যদিকে দেখেন।”

এই ধরনের মানুষরা কোনো আধুনিক সৃষ্টি নয়। হাজার বছর আগেও এই ধরনের মানুষ ছিল—

ওরা বলে, “(তোমরা যাই বলো না কেন) আমাদের অন্তর একদম সুরক্ষিত, কিছুই ঢুকবে না।” কিসের সুরক্ষিত? বরং আল্লাহ ওদেরকে ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করেছেন ওদের অবিশ্বাসের জন্য। ওদের বিশ্বাস একেবারেই নগণ্য পর্যায়ের। [আল-বাক্বারাহ ৮৮]

হাজার বছর আগে একদল ইহুদি কু’রআনের বাণীর অকাট্য যুক্তি, প্রমাণ দেখে তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বলত যে, এই সব ফালতু যুক্তি তাদের অন্তরে ঢুকবে না। তাদের অনেক জ্ঞান। সেই জ্ঞানের কারণে মুসলিমদের এই সব কথাবার্তা তাদের অন্তরকে আর স্পর্শ করতে পারবে না। তাদের অন্তর বিশেষ ভাবে সুরক্ষিত। তারা আল্লাহ, কিয়ামত, আখিরাত সম্পর্কে খুব ভালো করে জানে। তাদেরকে আর নতুন কিছু শেখানোর নেই।[১][১১][১৩]

এর উত্তরে আল্লাহ تعالى বলছেন, কিসের সুরক্ষিত? বরং তিনি تعالى ওদেরকে পরিত্যাগ করেছেন। একারণেই ওদের অন্তরে আর ভালো কিছু ঢোকে না। মূর্খের মতো নিজেদেরকে ভিআইপি মনে করে কোনো লাভ নেই। বরং ওরা একেবারেই হতভাগা। ওদের ক্রমাগত ভণ্ডামি এবং অবাধ্যতার জন্য তিনি تعالى ওদের অন্তরকে ঢেকে দিয়েছেন। এখন আর তাদের ভেতরে কু’রআনের বাণী ঢুকবে না। ওদেরকে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়েছে, আর না।

আরবিতে لعن এর অর্থ সাধারণত করা হয় ‘অভিশাপ দেওয়া’, যার কারণে কু’রআনের প্রচলিত বাংলা অনুবাদগুলোতে বলা হয়, “আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন।” কিন্তু لعن এর অর্থ অনেকগুলো— ১) পরিত্যাগ করা, ২) তাড়িয়ে দেওয়া, ৩) ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করা, ৪) অভিশাপ দেওয়া ইত্যাদি।[১৮০] আল্লাহর تعالى অভিশাপ দেওয়াটা, আর অভিশাপ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, তার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমরা যখন কাউকে অভিশাপ দেই, “তুমি ধ্বংস হয়ে যাও!” — তখন আসলে আমরা আল্লাহর تعالى কাছে একটি বদ দু’আ করি, যেন আল্লাহ تعالى তাকে ধ্বংস করে দেন। কিন্তু আল্লাহ تعالى যখন لعن করেন, তিনি تعالى কারো কাছে কিছু চান না, বরং তিনি ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করেন। বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তার কোনো সৃষ্টিকে পরিত্যাগ করা একটি ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ যাকে তিনি পরিত্যাগ করলেন, সে তখন চিরজীবনের জন্য নরকের অধিবাসী হয়ে গেল। শেষ বিচারের দিন সে আল্লাহর تعالى অনুগ্রহ, দয়া, ক্ষমা এবং ভালবাসা পেয়ে জান্নাতে যাওয়ার সব সুযোগ হারিয়ে ফেলল। সে সারাজীবনের জন্য ধ্বংস হয়ে গেল।

ওদের বিশ্বাস একেবারেই নগণ্য পর্যায়ের

এই আয়াতে একটা শেখার ব্যাপার আছে — শুধু জ্ঞান থাকলেই হবে না, সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ঈমান মানে শুধুই সত্যকে মুখে স্বীকার করা নয়, বরং সেটাকে কথায়-কাজে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। ইবলিসের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। সে সত্য কী তা জানতো। সে আল্লাহকে تعالى তার প্রভু হিসেবে মানত। কিন্তু তারপরেও সে চির জাহান্নামি হয়ে গেছে। কারণ তার বিশাল জ্ঞান, তার চিন্তাভাবনা এবং কাজে পরিবর্তন আনতে পারেনি।[৪]

এই আয়াতগুলো পড়ে সুধীবৃন্দরা অনেক সময় প্রশ্ন করেন, “দেখ, তোমাদের আল্লাহ কেমন বদরাগী, কথায় কথায় অভিশাপ দেয়। কোনো দয়াময় স্রস্টা মানুকে অভিশাপ দিতে পারে না। স্রস্টা যদি তার সৃষ্টিকে অভিশাপ দেয়, তাহলে সৃষ্টির কী দোষ?”

এর উত্তরটা এই আয়াতেই রয়েছে, একটু ভালো করে পড়লেই পাওয়া যাবে, “বরং আল্লাহ তাদেরকে ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করেছেন তাদের অবিশ্বাসের জন্য।” প্রথমে তারা অবিশ্বাস করেছে, মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে, সমাজে দুর্নীতি, অন্যায় ছড়িয়ে দিয়েছে। আল্লাহ تعالى তারপরও তাদের কাছে তাঁর تعالى বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও তারা সেই বাণী মেনে নেয়নি, নিজেদের লোভ, অহংকার এবং গোঁড়ামির জন্য। তাদের বারবার অবাধ্যতার জন্য একটা পর্যায়ে গিয়ে আল্লাহ تعالى তাদেরকে পরিত্যাগ করেছেন, যা প্রচলিত বাংলা অনুবাদগুলোতে বলা হয়, “আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন।”

এর পরের আয়াতে আরও বিস্তারিত বলা হয়েছে—

যখন তাদের কাছে আল্লাহর কাছ থেকে বাণী/আইন এসে পোঁছাল, যা তাদের কাছে ইতিমধ্যে যা আছে তাকে সত্যায়ণ করে, যখন কিনা তারা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য প্রার্থনাও করছিল। কিন্তু তারপরেও তারা তা অস্বীকার করল, যদিও কিনা তারা নিজেরাই জানতো যে তা সত্য বাণী/আইন। আল্লাহ এই সব অস্বীকারকারিদের ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করেছেন। [আল-বাক্বারাহ ৮৯]

হাজার বছর আগে ইহুদিরা সঙ্ঘবদ্ধ ছিল না। তারা নানা দলে বিভক্ত হয়ে শক্তিশালী আরব গোত্রগুলোর ছত্রছায়ায় দুর্বল অবস্থায় থাকত। তাদের নিজেদের কোনো এলাকা ছিল না। তাদের শত্রুরও কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে কিছু করার মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনী তাদের ছিল না। তাই তারা আল্লাহর تعالى কাছে বার বার প্রার্থনা করছিল, যেন আল্লাহ تعالى তাদেরকে একজন রাসুল দেন, যে তাদেরকে আবার সঙ্ঘবদ্ধ করে, তাদের কাফির শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়ী করে দেবে।[১১]

কিন্তু যখন তারা দেখল শেষ নবী মুহাম্মাদ عليه السلام এসেছেন এক আরব বংশে, এক আরব গোত্রে, সাথে সাথে তাদের জাত্যভিমান, অহংকার, হিংসা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তাওরাতের ভবিষৎবাণীর সাথে মুহাম্মাদ عليه السلام-এর জীবনী, কথা, আচরণ, প্রচারিত বাণীর হুবহু মিল থাকার পড়েও তারা তাঁকে عليه السلام অস্বীকার করল।[১১]

আজকের যুগে কী ঘটে দেখি। একটা সময় মানুষ অরাজকতা, অশান্তি, দুর্নীতি সহ্য করতে না পেরে আল্লাহর কাছে হাহাকার করে, যেন দেশে ইসলামের সুন্দর শাসন প্রতিষ্ঠা হয়, যেন আমরা আবার শান্তিতে বাস করতে পারি। তারপর দেশে যখন ইসলামের শাসন প্রচলন করার আলোচনা শুরু হয়, তখন শুরু হয় সমস্যা—

“ব্যাংক থেকে এতদিন যে সুদ নিয়ে চলতাম, সেটা ছেড়ে দিতে হবে? মাসে মাসে এতগুলো টাকা!”
“একি! আমাকে দেখি হিজাব করে চলতে হবে, না হলে রাস্তায় পুলিশ ধরবে!”
“হায় হায়! বন্ধুদের নিয়ে আর রাতে পার্টিতে যেতে পারব না? গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আর পার্কে কিছু করতে পারব না? এ কোন মান্ধাত্তা যুগে এসে পড়লাম?”
“কাস্টমস ফাঁকি দিয়ে আর মাল আনতে পারব না? পুরো ট্যাক্স দিতে হবে? ব্যবসা চলবে কী করে?”
“টিভিতে সব হিন্দি সিরিয়াল বন্ধ হয়ে যাবে? সারাদিন করব কী তাহলে?”

—“সর্বনাশ! এসব হতেই পারে না! জলদি আটকাও। ইসলামের শাসন যেন কোনোভাবেই দেশে আসতে না পারে। যতই খারাপ হোক, আগের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলটাকেই আবার চাই।”

মানুষের উপরে জোর করে ইসলাম চাপিয়ে দিলে এই হবে ফলাফল। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের ভেতরটাকে পরিষ্কার করা না হচ্ছে এবং মানুষের অন্তরে ঈমান না আসছে, তাদের উপর জোর করে ইসলাম চাপিয়ে দেওয়ার ফলাফল হবে ভয়ঙ্কর। দেশের বেশিরভাগ ক্ষমতাশালী, ধনী, প্রভাবশালী মানুষেরা,  যারা বাবা-মার দেওয়া আরব শব্দ বিশিষ্ট নাম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তাদের কথা-কাজেকর্মে-জীবন যাত্রায় ইসলামের ছিটেফোঁটাও নেই। এদের উপর ইসলামের শাসন চাপিয়ে দিলে আমরা এমন একটা দেশ তৈরি করব, যেখানে লক্ষ লক্ষ মুনাফেক গিজগিজ করতে থাকবে এবং তারা ভেতরে ভেতরে ইসলামিক সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকবে।

তখন শুরু হবে দলে দলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, এবং গৃহযুদ্ধ।  এর উদাহরণ আমরা হাজার বছর আগে সাহাবিদের সময় থেকে শুরু করে, পরবর্তীতে খালিফাদের যুগ, এমনকি বিংশ শতাব্দীতে মিশর, তুরস্ক সহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে দেখেছি। রাসুলের عليه السلام সুন্নাহ অনুসরণ করে প্রথমে আমাদেরকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক পর্যায়ে ইসলামের আলো পৌঁছে দিতে হবে। তারপর রাজনৈতিক ভাবে ইসলামের সমর্থন এবং বাস্তবায়ন অনেক সহজ হয়ে যাবে, এবং হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে।

মানুষের কাছে সত্য আসার পর তা বুঝতে পেরেও মানুষ যে সত্যকে অস্বীকার করে, তার একটি যুগোপযোগী উদাহরণ হলো—

চৌধুরী সাহেব একদিন মসজিদের খুতবায় ইমামকে ‘মকসুদুল মুমেনীন’, ‘নিয়ামুল কু’রআন’ বই দুটি নিয়ে অনেক প্রশংসা করতে শুনলেন। তার পর দিনই তিনি কষ্ট করে নীলক্ষেতে গিয়ে বই দুটো কিনে আনলেন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত এই বই দুটো পড়েন, আর সেই অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করেন। বই দুটিতে সব গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার জন্য শত শত শর্টকাট দু’আ, সারাজীবনের সব ‘ক্বাযা’ নামাজ মাফ হয়ে যাওয়ার জন্য এক মহা ক্বাযা নামাজ, জান্নাত নিশ্চিত হওয়ার জন্য মাত্র একরাতের সারারাত নফল নামাজ, ইত্যাদি নানা লোভনীয় বর্ণনা পড়ে তিনি মহাখুশি।

একদিন তার প্রতিবেশী তার টেবিলে বইদুটি দেখে আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ চৌধুরী সাহেব! এই বইদুটি আপনি পড়ছেন কেন? আপনি জানেন না এই বইগুলো ভরতি ভুল হাদিস এবং বিদ’আহ রয়েছে?”[১৮১]

চৌধুরী সাহেব ক্ষেপে গেলেন, “কী সব যা তা বলছেন আপনি! আমি মসজিদের ইমামকে এই বইগুলোর ব্যাপারে বলতে শুনেছি। আপনার যোগ্যতা কি তার থেকে বেশি নাকি?” এরপর তার প্রতিবেশী তাকে মদিনা, আল-আজহার ইউনিভারসিটি থেকে পিএইচডি করা লেখকদের বই দেখালেন, যেখানে বইদুটির বিপুল সমস্যা নিয়ে যথাযথ দলিল রয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। চৌধুরী সাহেব নিজের কষ্ট করে কেনা, বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা এই বইদুটি, যা কিনা আবার মসজিদের ইমাম কর্তৃক সত্যায়িত, ফেলে দিবেন এক প্রতিবেশীর দেখানো দলিল অনুসারে? হতেই পারে না।

অথচ তিনি খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন যে, তার প্রতিবেশী যা কিছুই বলছেন, তার সব যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ওনার কথা তিনি কেন শুনবেন? সে কোন মসজিদের ইমাম, কোন ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট করা যে, তিনি ওনার কথা শুনবেন? তার প্রতিবেশী কি ইসলাম সম্পর্কে তার থেকে বেশি জানে? তার বাবা, দাদা সারাজীবন এই বইদুটি পড়ে আমল করেছেন? তারা কি সবাই ভুল পথে ছিলেন? আর কোথাকার কোন প্রতিবেশী আল্লাহর تعالى বিশেষ রহমত পেয়ে সঠিক পথে আছে?

এই ধরনের চিন্তা যারা করেন, তারা সাবধান। তাদেরকে আল্লাহ চিরজীবনের জন্য পরিত্যাগ করতে পারেন। তাদের পরিণাম হচ্ছে নিচের এই আয়াত—

কী জঘন্য কারণে তারা নিজেদেরকে বেচে দিয়েছে আল্লাহর পাঠানো সত্যকে অস্বীকার করে। এই হিংসা করে যে, আল্লাহ তার ইচ্ছা মতো তার যে কোনো বান্দাকে অনুগ্রহ করেন। এরা নিজেদের উপর বারবার আল্লাহর ক্রোধ ডেকে এনেছে। এই সব অস্বীকারকারীদের জন্য চরম অপমানকর শাস্তি অপেক্ষা করছে। [আল-বাক্বারাহ ৯০]

এই ধরনের মানসিকতার মূল কারণ হচ্ছে হিংসা। তবে এটি ঠিক হিংসা নয়, সাইকোলজির ভাষায় একে বলে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স: অন্যের কাছে নিজের হীনমন্যতা ঢেকে রাখার জন্য নিজেকে বড় বলে জাহির করার এক ধরনের মানসিক প্রতিরক্ষা। হাজার বছর আগে একদল ইহুদি কোনোভাবেই মানতে পারছিল না: তাদের বংশে শেষ নবী عليه السلام না এসে অন্য বংশে কীভাবে আসলো? যেখানে মুসা عليه السلام নবীর মতো সব বড় বড় নবী এসেছেন তাদের বংশে, সেখানে কিনা শেষ পর্যন্ত সর্বশেষ নবী আসলো অন্য এক আরব বংশে? এটা কোনো কথা হলো?[২][৪][৬]

এই আয়াতে بَغْيًا মানে শুধু হিংসা নয়, বরং অন্যকে দমিয়ে রেখে নিজের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সন্মান জাহির করার একটা আক্রোশ।[১] এটাকে আধুনিক ভাষায় সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স বলা যায়।

আজকের যুগে একই ধরনের হিংসা, সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স-এর উদাহরণ দেখা যায়, যখন আপনি কাউকে দেখেন: সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না যে, আপনি তার যুগ যুগ ধরে করে আসা উপাসনাগুলোকে বিদ’আহ বলে প্রমাণ করে দিচ্ছেন; তার মাথা ভর্তি হাদিসগুলোকে জাল হাদিস বলে সংশোধন করে দিচ্ছেন। সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না যে, আপনি ইসলামের সঠিক শিক্ষা পেয়েছেন, আর সে সারাজীবন বাপদাদার অনুসরণ করে ভুল পথে ছিল।

আপনি তাকে যতই বোঝাবার চেষ্টা করেন, সে কোনোভাবেই শুনবে না, কারণ শুনলেই সে আপনার কাছে হেরে যাবে। তার এত দিনের কামানো ধর্মীয় বেশভূষা, নুরানি দাঁড়ি-পাঞ্জাবি-আতরের সন্মান, যেখানে কিনা মসজিদে তাকে দেখলে সবাই সরে গিয়ে প্রথম কাতারে জায়গা ছেড়ে দেয়, সেখানে কিনা আপনি তাকে বলছেন: তার ইসলামের ভিত্তিটাই ছিল ভুল? এটা হতেই পারে না! —তার হিংসা তাকে অন্ধ, বধির করে দিয়েছে। এই ধরনের মানুষদের পরিণাম ভয়ঙ্কর— এরা নিজেদের উপর বারবার আল্লাহর ক্রোধ ডেকে এনেছে। এই সব অস্বীকারকারীদের জন্য চরম অপমানকর শাস্তি অপেক্ষা করছে।

এই ধরনের মানুষদেরকে আপনি যতই প্রমাণ দেখান, যতই অনুরোধ করেন সঠিক ভাবে ইসলামকে বুঝে মেনে চলার, কু’রআনের বাণী বুঝে শুনে পড়ে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার —তারা কোনোভাবেই তা করবে না। কারণ তারা আপনাকে হিংসা করে এবং তাদের ভেতরে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স রয়েছে। তাদের এক শবে বরাতের রাতের নফল নামাজ পড়ে জান্নাতে যাওয়ার ভিআইপি টিকেট পাওয়ার অভ্যাস, এক লক্ষ বার কালেমা বিড়বিড় করে সব গুনাহ মাফ করে ফেলার এত সুন্দর শর্টকাট ব্যবস্থা, মরার পর ইমাম ভাড়া করে তিনদিনে ভড়ভড় করে কু’রআন খতম করে জান্নাতের দরজা জোর করে খুলে ফেলা —এগুলো যে সব ভুল, এত বড় একটা ব্যাপার তারা হিংসার চোটে কখনই মেনে নিবে না। তাও আবার আপনার মুখে শুনে।

একই ঘটনা হাজার বছর আগে একদল ইহুদির বেলায় ঘটেছিল—

যখন তাদেরকে বলা হলো, “আল্লাহর পাঠানো বাণীর উপর বিশ্বাস করো।” তারা উত্তর দিল, “আমরা শুধু সেটাই বিশ্বাস করব, যা আমাদেরকে আগে প্রকাশ করা হয়েছে।” তারা কোনোভাবেই এরপরে যা পাঠানো হয়েছে, তাতে বিশ্বাস করবে না, যদিও কিনা সেটা তাদের কাছে থাকা বাণীকেই সমর্থন করে। ওদেরকে বল, “কেন তোমরা তাহলে আল্লাহর নবীদেরকে হত্যা করেছ, যেখানে কিনা তোমরা নিজেদেরকে পাক্কা বিশ্বাসী বলে দাবি করো?” [আল-বাক্বারাহ ৯১]

পৃথিবীতে আর কোনো জাতি নেই যাদের ইতিহাস বনী ইসরাইলিদের মতো এতটা অকৃতজ্ঞতা, অবাধ্যতায় ভরপুর।[৬] তারা নৃশংসভাবে কয়েকজন নবীকে হত্যা করেছিল। যেমন, নবী জাকারিয়াকে عليه السلام তারা পাথর মেরে হত্যা করেছিল।[২][৬] নবী ইয়াহিয়ার عليه السلام মাথা কেটে তৎকালীন ইহুদি রাজার স্ত্রীকে একটা থালায় করে উপহার দিয়েছিল।[৩]  তারা ভেবেছিল নবী ঈসাকে عليه السلام তারা ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করেছে, কিন্তু তাকে আল্লাহ تعالى তাকে নিজের কাছে তুলে নেন। তারা মনে করত যে, শুধুমাত্র তারাই হবে আল্লাহর تعالى মনোনিত একমাত্র ধর্মপ্রচারক জাতি এবং নবীরা عليه السلام শুধুমাত্র তাদের বংশেই জন্মাবে।[৮]

তারা নিজেদেরকে পৃথিবীতে আল্লাহর تعالى ধর্মের একমাত্র বাহক মনে করত। এই অন্ধবিশ্বাস থেকে তারা নবী মুহাম্মাদকেও عليه السلام অস্বীকার করেছিল। এমনকি আজও অনেক সনাতন ইহুদিরা এই একই বিশ্বাস করে। তাদের বংশের বাইরে কেউ ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করতে পারে না। যদি করেও, তাকে তারা ইহুদি বংশের একজনের সমান অধিকার দেয় না।[৮] ধর্ম তাদের কাছে একটি বংশগত অধিকার। তারা মনে করে আল্লাহর تعالى সাথে তাদের বিশেষ সম্পর্ক আছে: প্রত্যেক ইহুদিকে তিনি জান্নাতের টিকেট দিয়ে রেখেছেন।[৩]

বনী ইসরাইলের যোগ্য উত্তরসূরি হচ্ছে মুসলিমরা। মুসলিম আলেমরা, যারা নবীদের عليه السلام দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আল্লাহর تعالى বাণীকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন —তাদেরকে হত্যা করার শত শত ঘটনা রয়েছে মুসলিমদের ইতিহাসে। একদম সাহাবীদের সময় থেকে শুরু করে আজকের যুগ পর্যন্ত অনেক সাহাবী, ইমাম, আলেমকে মুসলিমরা হত্যা করেছে, যখন তাদের কথা এবং কাজ সেই সময়ের সমাজ, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতাধীন রাজা বা সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে।[১৭৬]

আজও অনেক সময় মসজিদের ইমামকে কখনো দেশের সরকার বা এলাকার এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বললে, তাকে আর পরদিন থেকে মসজিদে দেখা যায় না। কোনো আলেম কলম, মাইক হাতে নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে, কয়েকদিন পর তাকে গুম করে ফেলা হয়। এমনকি ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং দলগুলোর মধ্যে এতটাই তিক্ততা তৈরি হয়েছে যে, এই সব দলের অনেক আলেমদেরকে নামাজ শেষে মসজিদ থেকে ফেরার পথে আর কোনোদিন বাড়ি পৌঁছুতে দেখা যায় না।[১৭৭]

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version