কুরআনের কথা

আমরা জাহান্নামে কয়েকটা দিন মাত্র থাকব — আল-বাক্বারাহ ৮০-৮২

আপনি চৌধুরী সাহেবকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছেন তার হারাম ব্যবসাটা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু সে পাত্তা দিচ্ছে না। তার কথা হচ্ছে, “ভাই, বুঝলাম এই ব্যবসার জন্য আমার শাস্তি হবে। কিন্তু একদিন না একদিন তো জান্নাতে যাবই। কত হাজার টাকা এতিম খানায় দিলাম, গরিব আত্মীয়স্বজনদের দিলাম। জীবনে কত নামায পড়েছি, রোযা রেখেছি। কয়েকটা দিন না হয় জাহান্নামে কষ্ট করলামই। কী যায় আসে?” এই ধরনের মানুষদেরকে আল্লাহ تعالى সতর্ক করছেন—

আর ওরা বলে, “আগুন আমাদেরকে মাত্র কয়েকটা দিনই স্পর্শ করবে।” বল, “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোনো অঙ্গীকার নিয়েছ, কারণ আল্লাহ তার অঙ্গীকার ভাঙ্গেন না? নাকি তোমরা আল্লাহর সম্পর্কে না জেনেই কথা বল?” [আল-বাক্বারাহ ৮০]

যারা কু’রআন কখনো পুরোটা একবারও অর্থ বুঝে পড়ে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেননি, তারা এই ধরনের কথা বলেন। ইসলাম সম্পর্কে তারা নিজেদের ভেতরে একটা ধারণা করে নিয়েছেন। তাদের কাছে ইসলাম হচ্ছে: জীবনে যত খারাপ কাজ করেছি, তার জন্য কিছু সময় জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে, তারপর জান্নাতে গিয়ে পার্টি আর পার্টি। অনেকের মধ্যে একটা ধারণা আছে: যারা নামে মুসলিম (ঈমান না থাকলেও), তারা  সবাই জান্নাতে যাবেই। পাপের জন্য কয়েকটা দিন হয়ত জাহান্নামে শাস্তি পেতে হবে। তারপর জান্নাতে গিয়ে সব ভুলে যাবে। তাই এই দুনিয়ায় যে পাপ করছি, সেটা কোনো ব্যাপার না। একদিন না একদিন তো জান্নাতে যাবই। “হাজার হোক, আমার নাম আব্দুল্লাহ। আমার পাসপোর্টে ধর্ম লেখা আছে ‘ইসলাম’। আমি মুসলিম দেশে জন্মেছি! আমি জান্নাতে যাব না তো যাবে কে?”[১৬৮]

সাইকোলজির ভাষায় এটা হচ্ছে এক ধরনের ‘কনফারমেশন বায়াস’।[১৭০] মানুষের ভেতরে একধরনের ঝোঁক বা প্রবণতা থাকে: সে যা বিশ্বাস করে সেটাকে সঠিক হিসেবে প্রমাণ করার। তার কাছে যখন কোনো তথ্য বা প্রমাণ আসে, সে সেটাকে এমনভাবে বুঝে নেয়, যা তার আগে থেকে ধরে রাখা বিশ্বাসকে সমর্থন করে। এমনকি তার কাছে যদি অপ্রাসঙ্গিক কোনো তথ্যও আসে, সে সেটাকে এমনভাবে গ্রহণ করে, যেন সেটা তারই বিশ্বাসকে সমর্থন করছে। তার বিশ্বাসের পক্ষের যুক্তিগুলো সে খুব ভালো করে শোনে, খুব ভালো করে মনে রাখে। কিন্তু তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধের যুক্তিগুলো তার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন তাকে তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু বললেও কোনো লাভ হয় না। সে ঘুরে ফিরে বিভিন্নভাবে নিজেকে নানাভাবে বোঝাতে থাকে, যেন সে তার বিশ্বাসে অটুট থাকতে পারে। এই কনফারমেশন বায়াস সবার ভেতরেই কম বেশি আছে।

এই ধরনের মানুষদের কনফারমেশন বায়াসকে আল্লাহ تعالى ভেঙ্গে দিচ্ছেন: “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোনো অঙ্গীকার নিয়েছ, কারণ আল্লাহ তার অঙ্গীকার ভাঙ্গেন না?”

তারা কি আল্লাহর تعالى কাছ থেকে কোনো গ্যারান্টি নিয়েছে যে, তিনি তাদেরকে একদিন না একদিন জান্নাত দিবেনই? তাদের ঈমান গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে কি? অথবা মৃত্যুর আগে তারা ঈমানের ওপর থাকবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? একইসাথে তারা কি আল্লাহর কাছ থেকে গ্যারান্টি নিয়েছে যে, জাহান্নামে থাকার সময়টা দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে, যেখানে জাহান্নামের এক মুহূর্ত ও একটু শাস্তিও পৃথিবীর কোনো কষ্টের সাথে তুলনা করা যায় না? কোথায় সেই গ্যারান্টি দেখাক দেখি?

মুসলিম হলেই কি জান্নাত পাওয়া যায়? 

কয়েকদিন জাহান্নামে শাস্তির পর জান্নাতে চলে যাবেই — এই ভুল ধারণা বনী ইসরাইলের ছিল, যারা ছিল সেই যুগের মুসলিম। কোনো কারণে নিজেদের প্রতি এমন অতি আত্মবিশ্বাস আজকে মুসলিমদের মধ্যেও চলে এসেছে। সূরা বাকারাহ সহ আরও কমপক্ষে ১০টি আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে বলেছেন: শুধু ঈমান এনেছি বললেই হবে না, একইসাথে আমাদেরকে ভালো কাজ (عَمِلُوا۟ ٱلصَّٰلِحَٰتِ) করতে হবে, যদি আমরা জান্নাতে যেতে চাই।[১৬৮] আর ঈমান একটা বড় ব্যাপার। কেউ মুসলিম দাবী করলেই ঈমানদার হয়ে যায় না। ঈমান যথেষ্ট কষ্ট করে অর্জন করতে হয় এবং তার থেকেও বেশি কষ্ট করে ধরে রাখতে হয়। একজন মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলল, কিন্তু ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ মানে কী সেটা বুঝল না, -এর সাতটি শর্ত পূরণ করল না;[১৭৫]  ‘লোকে কী বলবে’ এই ভয়ে সে আল্লাহর تعالى নির্দেশকে প্রতিদিন অমান্য করল; নিজের কামনা-বাসনা পূরণ করার জন্য জেনে শুনে কু’রআনের নির্দেশ অমান্য করল; ইসলামকে সঠিকভাবে মানার জন্য নিজের ভেতরে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার কোনো ইচ্ছাই তার ভেতরে নেই — এই ধরনের মানুষের ভেতরে ঈমান এখনও জায়গা পায়নি। তারা কেবল হয়ত মুসলিম হয়েছে বা নিজেকে শুধুই মুসলিম বলে দাবি করেছে।[১৬৮]

কেউ নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করুক আর না করুক, তার অবস্থা যদি এই আয়াতের মতো হয়, তাহলে সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন—

কখনই না! যে একটিও বড় পাপ অর্জন করে এবং তার পাপের ধারাবাহিকতা তাকে ঘিরে রাখে — ওরাই হচ্ছে (জাহান্নামের) আগুনের সহযাত্রী। সেখানেই তারা অনন্তকাল [বা অনেক লম্বা সময়] থাকবে। [আল-বাক্বারাহ ৮১]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى এক বিশেষ প্রজাতির মানুষের কথা বলেছেন, যাদের অবাধ্যতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তিনি تعالى বলছেন: যারা ‘একটিও বড় পাপ’ করে। سَيِّئَةً — যা এসেছে سُوء থেকে, যার অর্থগুলো হলো: নিজের বা অন্যের জন্য ক্ষতিকারক কাজ, অশ্লীলতা, অপব্যবহার, অন্যায় সুবিধা নেওয়া।[১৬৯] এটি হচ্ছে ঘৃণিত পাপ, বড় পাপ, যেমন মদ বা মাদকের প্রতি আসক্তি, ব্যভিচার, সুদ, হারাম ব্যবসা, অশ্লীলতা ইত্যাদি।[১] এটি  ছোটখাটো পাপ ذنب নয়।[১] এই ধরনের একটি পাপ যে করে, তারপর যখন সেই পাপ তার জীবনটাকে ঘিরে ফেলে, সেই পাপ থেকে সে কোনোভাবেই বের হয় না, বরং সেই পাপ তাকে অন্যান্য পাপের দিকে নিয়ে যেতে থাকে, তাকে হাজার বুঝিয়েও লাভ হয় না, সে জাহান্নামের পথে চলতেই থাকে— সে চিরজীবন জাহান্নামে থাকবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করেন।

হতে পারে সে কিছু ভালো কাজও করে। কিন্তু সেই পাপটা সে করবেই, এবং সেটা নিয়ে তার কোনো অনুশোচনা নেই। তাকে কু’রআন থেকে যতই প্রমাণ দেখানো হোক না কেন, সেই পাপ করা সে কোনোভাবেই ছাড়বে না। সে পাপটাকে হারাম মানে না। সে তার নিজের ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্তকে আল্লাহর تعالى ইচ্ছা থেকে উপরে স্থান দিয়েছে। তার প্রভু আর আল্লাহ تعالى নয়, তার প্রভু হয়ে গেছে তার নিজের ইচ্ছা। এভাবে সে আল্লাহর تعالى আয়াতের কুফরি করেছে এবং আল্লাহর تعالى সাথে শিরক করছে, যার শাস্তি চির জাহান্নাম।[১][১১]

মানুষ যখন ছোট খাটো পাপ অনায়াসে করতে অভ্যস্ত হয়, তখন বড় পাপে জড়িত হওয়ার পথ খুলে যায়। আর বড় পাপগুলো কুফর ও শিরকের কাছাকাছি করে দেয়। এক পর্যায়ে ইসলাম থেকেই বের করে নেয়। ফলে তখন চিরস্থায়ী জাহান্নামই তার ঠিকানা হয়ে যায়।

এই ধরনের মানুষের উদাহরণ আমরা চারপাশে তাকালে দেখতে পারব, যারা হয়ত নিয়মিত জুম’আর নামায পড়ে, ফকিরদেরকে টাকা পয়সা দেয়, কুরবানির ঈদে লক্ষ টাকার গরু কিনে জবাই করে। কিন্তু তারপরে দেখা যায়: তারা তাদের হারাম ব্যবসা কোনোভাবেই ছাড়বে না। তারা কোনোভাবেই রাতের বেলা একটু হুইস্কি না টেনে ঘুমাতে যাবে না। তারা কোনোভাবেই ইন্টারনেটে পর্ণ দেখার অভ্যাস থেকে বের হবে না। তারপর তারা বিদেশে গেলে … না করে ফিরবে না। —এই ধরনের মানুষদেরকে পাপ ঘিরে ফেলেছে। তারা ঠিকই লক্ষ্য করছে যে, একটা পাপের কারণে তারা অন্যান্য পাপে জড়িয়ে পড়ছে। তারা খুব ভালো করে জানে তাদের কাজটা হারাম, কিন্তু তারপরেও তারা নানাভাবে সেই পাপ কাজকে সমর্থন করে। তারা কোনোভাবেই সেই পাপ থেকে বের হবে না। এমনটা নয় যে, তারা প্রবৃত্তির তাড়নায় এই পাপগুলো করছে। বরং তারা জেনে শুনেই ইচ্ছা করে অবাধ্য হয়ে পাপগুলো করছে। —এদের পরিণাম ভয়ঙ্কর।

এই আয়াতে خَطِيٓـَٔتُ এর অনুবাদ সাধারণত ‘পাপ’ করা হলেও, এটি হচ্ছে পাপের কারণে যে ফলাফল হয়, বা সঠিক রাস্তা থেকে দূরে চলে যাওয়া। এখানে আল্লাহ تعالى বলছেন যে, যে বড় পাপ করে, তারপর পাপের ধারাবাহিকতায় করা কাজকর্ম তার জীবনটাকে ঘিরে ফেলে।

যেমন, চৌধুরী সাহেব বিশাল পরিমাণের ঘুষ খাইয়ে একটা সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্ট হাতালেন। এর জন্য তিনি মন্ত্রীকে গুলশানে দুইটা ফ্ল্যাট কিনে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন। তারপর ব্যাংকের লোণ নিয়ে জোগাড় করা সেই বিশাল অংকের ঘুষ, সুদ সহ শোধ করতে গিয়ে, এবং মন্ত্রীকে কথা দেওয়া দুইটা ফ্ল্যাটের টাকা উঠানোর জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্রজেক্টের অনেক টাকা এদিক ওদিক সরিয়ে ফেলতে হলো। দুই নম্বর সস্তা কাঁচামাল সরবরাহ করতে হলো। যোগ্য কনট্রাক্টরদের কাজ না দিয়ে অযোগ্য, সস্তা কনট্রাক্টরদের কাজ দিতে হলো, যারা কিনা তাকে প্রচুর ঘুষ খাওয়ালো। এরপর একদিন তার প্রজেক্ট ধ্বসে পড়ল। তার নামে ব্যাপক কেলেঙ্কারি হয়ে মামলা হয়ে গেলো। মামলায় উকিলের টাকা জোগাড় করতে তাকে আরও বিভিন্ন উপায়ে টাকা মারা শুরু করতে হলো। তারপর কয়েকদিন পর পর তাকে পুলিশ ধরতে আসে, আর তিনি পুলিশের উপরের তলার লোকদের ঘুষ খাইয়ে পুলিশকে হাত করে ফেলেন। প্রজেক্টে দুর্নীতির কারণে ভুক্তভুগি মানুষদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে অনেক টাকা খরচ করে কিছু ‘সোনার ছেলে’ পালতে হয়। তারা মাঝে মাঝেই খুন, ধর্ষণ করে, হোটেলে থেকে … করে এসে বিরাট বিল ধরিয়ে দেয়। তারপর তাদেরকে যখন পুলিশ ধরতে আসে, তিনি পুলিশকে টাকা খাইয়ে তাদেরকে রক্ষা করেন। এত দুশ্চিন্তার মধ্যে তিনি রাতে কোনোভাবেই ঘুমাতে পারেন না। দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্য তাকে নিয়মিত মদ খাওয়া ধরতে হয়। এভাবে একটার পর একটা পাপে তিনি জড়িয়ে পড়তে থাকেন। পাপের ধারাবাহিকতা তার জীবনটাকে ঘিরে ফেলে।

এই আয়াতে আল্লাহ বলেননি, “যারা একটি পাপ করে”, বরং তিনি বলেছেন, “যারা একটিও পাপ অর্জন করে।” এ থেকে আমরা এই ধরনের পাপীদের মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা পাই: তারা চেষ্টা করে সেই পাপ অর্জন করে। পাপটা এমনিতেই ভুলে হয়ে যায় না। বরং তারা সেই পাপ করে একধরনের পরিতৃপ্তি পায়। সেই পাপ করে তার কোনো অনুশোচনা নেই, এটা তার কাছে একটা অর্জন। তারা মনে করে যে, এই পাপ করা কোনো ব্যাপার না, অন্য সবাই করছে না?[৬]

কষ্টের উপর কষ্ট

শেষ অংশটি ভয়ঙ্কর — “সেখানে তারা চিরজীবন থাকবে।” আমরা যখন পৃথিবীতে কষ্টে থাকি, আমাদের মনে একটা সান্ত্বনা থাকে যে, আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই কষ্ট শেষ। যেমন, ধরুন আপনার গায়ে একদিন ফুটন্ত গরম পানি পড়ে গা ঝলসে চামড়া উঠে গেলো। আপনি তিনদিন তিনরাত ধরে এক মুহূর্তের জন্য না ঘুমিয়ে বিছানায় ছটফট করে ব্যথায় চিৎকার করছেন। প্রতিটা সেকেন্ড আপনার কাছে মিনিট মনে হচ্ছে। প্রত্যেকটা হৃদস্পন্দনের সাথে সাথে আপনার চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে আপনি নিজেকে বোঝাচ্ছেন: “আর একটু, আর কয়েকটা দিন; তারপরেই ব্যথা কমে যাবে, ঘুমিয়ে যাবো, কষ্ট কমে যাবে…”

—এভাবে পৃথিবীতে আমরা প্রচণ্ড কষ্টের কিছু অভিজ্ঞতা ধৈর্য ধরে পার করি, কারণ আমরা জানি একদিন সেই কষ্ট শেষ হবে। এই আশা আমাদেরকে কষ্ট সহ্য করার শক্তি দেয়, ধৈর্য ধরার অনুপ্রেরণা দেয়। কিন্তু এই ধরনের মানুষরা, যারা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে, তাদের কোনো আশা নেই। তাদের ধৈর্য ধরার কোনো অনুপ্রেরণা নেই। তারা জানে: তাদের এই প্রচণ্ড কষ্ট কখনো শেষ হবে না। এই প্রচণ্ড দুর্গন্ধ, প্রচণ্ড গরম, অমানুষিক অত্যাচার — কখনো শেষ হবে না। কখনো তারা একটুও ঘুমাতে পারবে না। কখনো তাদের শরীরের কষ্ট একটুও কমবে না। কোনোদিন তারা আগের সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। —এই ভয়ঙ্কর মানসিক অবস্থা তাদের কষ্টকে হাজার গুনে বাড়িয়ে দেয়। জাহান্নামের প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণার সাথে যোগ হবে এক বুক ফাটা আতঙ্কের উপলব্ধি: এখানে তারা চিরজীবন থাকবে।[১১]

কারা জান্নাতে যাবে?

তবে এর পরের আয়াতটি আমাদের জন্য আশার বাণী—

আর যারা ঈমান এনেছে এবং ভালো কাজ করেছে — ওরা হচ্ছে বাগানের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরজীবন থাকবে। [আল-বাক্বারাহ ৮২]

যারা ঈমান অর্জন করেছে এবং একই সাথে ভালো কাজ করেছে, তারা হবে জান্নাতের বাগানের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।  আল্লাহ تعالى এখানে ٱلصَّٰلِحَٰت ব্যবহার করেছেন, যার মানে হচ্ছে, ভালো কাজের পরিমাণ অনেক নয়। আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে বেশি কিছু চান না।[১] তিনি চান যে, আমরা ঈমান আনি, যার মানে হচ্ছে— ১) আল্লাহকে تعالى একমাত্র ইলাহ মেনে নিয়ে তাঁকে সবার এবং সবকিছুর উপরে স্থান দেওয়া, ২) তাঁর تعالى বাণীতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে তাঁর নিষেধ থেকে দূরে থাকা এবং আদেশগুলো যথাসাধ্য মেনে চলা, ৩) নবী-রাসুলে পরিপূর্ণ আস্থা রাখা, তাদের শিক্ষা জীবনে বাস্তবায়ন করা, এবং মুহাম্মাদ عليه السلام -কে শেষ নবী ও রাসূল বিশ্বাস করা, ৪) ফেরেশতা, ৫) কদরে বিশ্বাস রাখা এবং ৬) শেষ বিচার দিনের বিচারে বিশ্বাস রেখে সেই বিচারে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা— এগুলো ঈমানের ৬টি খুঁটি। আর এর সাথে সাথে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে সাধ্যমত কিছু ভালো কাজ করলেই আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর অসীম করুণায় জান্নাত দিয়ে দেবেন বলে কথা দিয়েছেন।

জান্নাত কেন বাগান?

বাগান হচ্ছে আগুনের সম্পূর্ণ বিপরীত। আগুনে রয়েছে শুধুই কষ্ট, আর বাগানে রয়েছে শুধুই আনন্দ। ব্যথার বদলে সেখানে রয়েছে আরাম। ভয়ের বদলে প্রশান্তি। দুঃখের বদলে অনাবিল সুখ। এই বাগান হচ্ছে আল্লাহর تعالى সন্তুষ্টির প্রকাশ। পৃথিবীতে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যে একটি সুন্দর বাগান দেখলে সেখানে থাকতে চাইবে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। আল্লাহ تعالى মানুষকে তৈরিই করেছেন এই সৌন্দর্যকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে। গ্রামের একটা ছেলের মনে হয়তো আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে নিউইয়র্কের ১০০ তলা ভবনে একটি অত্যাধুনিক এপার্টমেন্টে বিশাল স্ক্রিনের টিভি, কম্পিউটার, হট শাওয়ার, ভিডিও গেম এইসব নিয়ে জীবন পার করে দেওয়ার। কিন্তু সে-ও সেই কংক্রিটের জঙ্গলে কয়েক বছর থাকার পর হাঁসফাঁস করতে থাকবে আবার খোলা প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য।

জান্নাত নিয়ে আসুন একটু কল্পনা করি—

সবুজ ঘন কার্পেটের মতো মোলায়েম ঘাসে ভরা বাগান। চারিদিকে হাজারো রঙিন ফুল, সুস্বাদু ফল। বাগানের মধ্যে দিয়ে ঝকঝকে পরিষ্কার পানির ধারা। ঘন সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে দূরে ঝর্ণার কলকল শব্দ আসছে। চারিদিকে সুস্বাদু খাবার এবং পানীয়ের চমৎকার আয়োজন। মুখে স্নিগ্ধ বাতাস, গায়ে নরম রোদ পড়ছে। এখানে কোনো কোলাহল নেই। কোনো অসুখ নেই। কেউ কোনো বাজে কথা বলছে না, কোনো তর্ক করছে না। সবার মুখে হাঁসি। সবাই মুগ্ধ হয়ে বাগানের প্রশংসা করছে, সুন্দর সব গল্প করছে, একে অন্যকে দেখলেই সালাম দিচ্ছে। এই বাগান আজকে আপনার। আপনাকে আর কোনোদিন এই বাগান ছেড়ে যেতে হবে না। আপনার মনে আর কোনো দুঃখ নেই, কোনো কষ্ট নেই, কোনো অভিমান নেই। এক গভীর সুখের অনুভূতিতে আপনি ডুবে আছেন, আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন — একটু পরেই এক অসাধারণ ঘটনা ঘটবে। আপনি সারাজীবন যাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, সেই আপনার মহান প্রভু, আপনার সামনে প্রথমবারের মতো তাঁকে প্রকাশ করতে যাচ্ছেন!

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, এই জান্নাত, জাহান্নাম কোনো রূপকথার গল্প নয়। এটি কঠিন বাস্তবতা। আপনি, আমি সহ পৃথিবীর সবাই একদিন না একদিন এই দুটির কোনো একটিতে গিয়ে পৌছাবই। আমরা যদি সত্যিই বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ تعالى আছেন, তাহলে আমাদের জেগে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত চেষ্টা করতে হবে: কী করলে আমরা আল্লাহকে تعالى যথাসম্ভব খুশি করে জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি পেতে পারি, এবং জাহান্নামের ভয়ঙ্কর আগুন যেন আমাদেরকে একদিনও স্পর্শ না করে।

জান্নাত জাহান্নামের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি আল্লাহর

আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিকহ শাস্ত্রে পিএইচডি করা, অন-ইসলাম সংগঠনের শারিয়াহ ডিপার্টমেন্টের প্রধান ড: ওয়েল শিহাব-এর একটি চমৎকার ব্যাখ্যা আছে[১৭৬]

আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি যে, শেষ বিচার শুধুমাত্র আল্লাহর হাতে, যিনি সর্বশক্তিমান, সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ, তিনি মানুষদের সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন, তাদের প্রতি সবচেয়ে করুণাময়, সবচেয়ে দয়ালু। আমরা কখনই কাউকে বিচার করতে পারব না বা কারও পরিণাম নির্ধারণ করতে পারব না। বরং ইসলাম এটা কখনই সমর্থন করে না যে, কেউ অন্য কোনো মানুষের জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করে দিক, তার বিশ্বাস যাই হোক না কেন।

অনেক মুসলিম আলেম বলেছেন, কেউ যেন অন্য কাউকে অবজ্ঞা ভরে না দেখে, কারণ হতে পারে সে তার থেকে আল্লাহর আরও কাছের। আমাদের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন আমাদের অন্তরে কী আছে, আমাদের নিয়ত, আমাদের কাজ, আমাদের কথা। তিনি জানেন আমরা কাউকে আঘাত করেছি কিনা, বা আমরা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে শান্তি এবং সমঝোতা আনার চেষ্টা করেছি কিনা। এমনকি ইসলামে একজন মুসলিম কখনই নিশ্চিত হতে পারে না যে, সে জান্নাতে যাবে না জাহান্নামে যাবে।

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version