কুরআনের কথা

এত কিছুর পরও তোমরা ফিরে গেলে — আল-বাক্বারাহ ৬৪-৬৬

চৌধুরী সাহেবের সন্তানটির জন্ম হলো ডেলিভারির তারিখের দুই মাস আগে। তাকে সাথে সাথে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলেন। নার্সরা এসে তাকে সান্ত্বনা জানাচ্ছে, তাকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছে। এই অবস্থায় তিনি জায়নামাজে বসে জীবনে প্রথমবারের মতো আল্লাহর تعالى কাছে অনেক কাঁদলেন। সারাজীবন আল্লাহর تعالى অবাধ্যতা করার জন্য ক্ষমা চাইলেন। বাকি জীবন দৃঢ়ভাবে ইসলাম মেনে চলার জন্য শপথ করলেন। তারপর ভেজা চোখে আইসিইউতে ফিরে গিয়ে দেখলেন: ডাক্তাররা ছোটাছুটি করছে — তার শিশুটির অবস্থা কোনো এক অদ্ভুত কারণে ভালো হতে শুরু করেছে! আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞতায়, শ্রদ্ধায় তিনি খুশিতে কেঁদে ফেললেন। মনে মনে অসংখ্যবার আল্লাহকে تعالى ধন্যবাদ দিলেন। একটু আগে করা শপথের কথা নিজেকে বার বার মনে করিয়ে দিলেন।

এক বছর পরের ঘটনা। চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠান চলছে। ডিজে নিয়ে এসে ব্যাপক ধুমধাম করে ডিস্কো হচ্ছে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, নারী-পুরুষ সবাই মাখামাখি করে নাচানাচি করছে। চারিদিকে রঙ বেরঙের পানীয়। টিভিতে প্রায় নগ্ন গায়িকার মিউজিক ভিডিও চলছে। ওদিকে বাইরে মাগরিবের আজান হচ্ছে। কিন্তু গানের শব্দে কেউ আজান শুনতে পারছে না।

এত কিছুর পরও তোমরা (সঠিক পথ থেকে) ফিরে গেলে। যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ এবং দয়া না থাকত, তাহলে তোমরা অবশ্যই সব হারিয়ে ফেলতে। [আল-বাক্বারাহ ৬৪]

বনী ইসরাইলিদের আল্লাহ تعالى অনেক অনুগ্রহ করেছিলেন। তাদেরকে তিনি ফিরাউনের বীভৎস অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তাদেরকে মরুভূমিতে মেঘের ছায়া, পানীয়, খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাদেরকে একটি শহরের উপর আধিপত্য দিয়ে দিয়েছিলেন, যেন তারা সেখানে সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু এরপর নবী মূসা عليه السلام যখন তাদের জন্য তাওরাত নিয়ে এলেন, তারা দেখল তাওরাত মেনে চলা খুবই কঠিন। তখন তারা মিথ্যা কথা প্রচার করা শুরু করল যে, আল্লাহ تعالى নাকি বলেছেন, যেটুকু মানা সম্ভব সেটুকু মানলেই চলবে, বাকিটা আল্লাহ تعالى ক্ষমা করে দিবেন।[৪][৮] তাদের এই ভণ্ডামির উত্তরে আল্লাহ تعالى তূর পর্বতকে তাদের মাথার উপর তুলে ধরে ভীষণ ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে শপথ নিলেন, যেন তারা তাওরাতকে নিষ্ঠার সাথে, দৃঢ় ভাবে মেনে চলে। এরকম ভয়ংকর ঘটনার পরেও তারা বিভিন্নভাবে আল্লাহর تعالى নির্দেশকে ফাঁকি দেওয়া শুরু করল।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বলছেন—

فَلَوْلَا فَضْلُ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُۥ

যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ এবং দয়া না থাকত…

এখানে কোন অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে? فَضْل এর অর্থগুলো হচ্ছে ১) অনুগ্রহ, ২) আচরণগত পরিমার্জনা, ৩) অকৃপণ দান, উদারতা, ৪) বিনামূল্যে উপহার।[১৪৭] প্রাপ্যের বেশি কিছু দেওয়া, বাড়তি অনুগ্রহ করা হচ্ছে ফাদ’ল। আল্লাহ تعالى বনী ইসরাইলিদের অনেক অনুগ্রহ করেছিলেন, যেরকম তিনি অন্য কোনো জাতিকে করেছেন বলে ইতিহাসে জানা নেই। কিন্তু এরপরও তারা বার বার আল্লাহর تعالى অবাধ্যতা করে এক ভীষণ অপমানিত জাতিতে পরিণত হয়েছে।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এক অসাধারণ ফাদ’ল দিয়েছেন — কু’রআন। আজকে আমরা যদি খ্রিস্টান হতাম, তাহলে আমাদের অবস্থা হতো ভয়ংকর। আমরা একজন ভণ্ড নবী সেইন্ট পলের বিকৃত খ্রিস্টান ধর্ম অনুসরণ করে, যীশুকে ঈশ্বর মনে করার মতো হাজারো ভুল শিক্ষা পেয়ে, জীবনটা দুর্বিষহ করে ফেলতাম। প্রতি রবিবার গির্জায় গিয়ে একটা প্রায় নগ্ন মূর্তির দিকে ভক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। ভয়ংকর অশ্লীল, বিকৃত ঘটনায় ভরা বাইবেল পড়তাম। বিশ্বাস করতাম যে, ঈশ্বরকে শূলে চড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, আর সেজন্য আমার সব পাপ মুছে গেছে, আমি এখন নিষ্পাপ। এই সব উল্টোপাল্টা কথা শুনে সারাক্ষণ মনের মধ্যে একটা খটকা থেকে যেত: “এরকম অযৌক্তিক একটা ব্যাপার সত্য হতেই পারে না। কিছু একটা ঘাপলা আছে এর মধ্যে।”

তারপর সত্য খুঁজতে খুঁজতে একদিন যখন ইসলাম খুঁজে পেতাম এবং মুসলিম হওয়ার চেষ্টা করতাম, সাথে সাথে শুরু হতো পরিবার, বন্ধুবান্ধবের সাথে ঝগড়াঝাঁটি, মনোমালিন্য। আত্মীয়স্বজন দূরে চলে যেত। পরিবারের সদস্যরা দুর্ব্যবহার করত। স্ত্রী হলে স্বামীকে ছেড়ে চলে আসতে হতো, স্বামী হলে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিতে হতো। অনেক বন্ধুকে চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলতাম। এত সব কষ্ট করতে হতো, শুধুই সত্যকে অনুসরণ করার জন্য।

আমরা মুসলিমরা অনেক ভাগ্যবান যে, আমাদেরকে এই কঠিন জীবনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি এবং হবেও না। আমরা কু’রআন পেয়েছি, যেটা নিঃসন্দেহে মহান সৃষ্টিকর্তার تعالى বাণী। অন্য কোনো সত্য ধর্ম আছে কিনা, তা খুঁজে বের করার জন্য আমাদের আর কষ্ট করার দরকার নেই। আমাদের মনের ভিতরে সবসময় কোনো কাঁটা খচ্‌খচ্‌ করে না: “আমরা সত্যিই সঠিক ধর্ম মানছি তো?”

সুতরাং, এখন আমাদের দায়িত্ব: আমাদের উপরে দেওয়া এত বড় অনুগ্রহের সঠিক মর্যাদা দিয়ে, আল্লাহর تعالى প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে, তাঁর দেওয়া জীবনবিধান দৃঢ়ভাবে মেনে চলা। ‘লোকে কী বলবে?’ — তা ভয় না পেয়ে, বরং ‘আমি আল্লাহকে কীভাবে মুখ দেখাবো?’ — এই চিন্তায় নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখতে হবে। এটাই হলো আল্লাহর تعالى প্রতি তাক্বওয়া, যা একজন মু’মিন হয়ে জান্নাতে যাওয়ার পূর্ব শর্ত।

আমাদের স্কুল জীবনে দশ বছরে আমরা প্রায় ৮০টা টেক্সট বই পড়ি। এর সাথে আরও ৫০টা পাঞ্জেরি গাইড পড়ি। কলেজে উঠে আরও ২০টা এবং ইউনিভারসিটিতে আরও ৩০টার মত বই পড়া হয়। মোটমাট ১৫০টার মত টেক্সট বই, শ’খানেক গল্পের বই এবং ম্যাগাজিন ইউনিভারসিটি পাস করতে গিয়ে আমাদের সবারই পড়া হয়। অথচ পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই বইটা, একটা মাত্র বই, সেটা আমাদের পড়ার সময় হয় না।

যেই বই না পড়লে আমাদের বেঁচে থাকাটা অর্থহীন, মারা যাওয়াটা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল, যে বইয়ে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব সমস্যার সমাধান দেওয়া আছে — সেটা আমরা না নিজেরা পড়ি, না আমাদের বাবা-মা আমাদেরকে পড়ার জন্য কোচিং সেন্টারে জোর করে পাঠান।

আমরা অনেকেই গানের নোটের মত একটি বিদেশি অক্ষরে সুর করে সেই বইয়ের শব্দগুলো গুন গুন করা শিখি। কিন্তু সেই বইয়ের যে প্রকৃত বাণী, যা আমাদেরকে শেখানোর জন্য শ্রেষ্ঠ মানুষটি عليه السلام ২৩ বছর চরম সংগ্রাম করেছেন, মানুষের গালি খেয়েছেন, অকথ্য নির্যাতনে জ্ঞান হারিয়েছেন; যেই জ্ঞান এবং উপলব্ধি আমাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য হাজারো মানুষ নির্যাতনে, যুদ্ধে জীবন দিয়ে দিয়েছেন — সেটা জানার এবং বোঝার আগ্রহ, সময়, ধৈর্য আমাদের হয় না।

এই আয়াতে আমাদের একটি শেখার ব্যাপার আছে: আল্লাহর تعالى ক্ষমা এবং দয়ার উপর আশা হারিয়ে ফেললে হবে না। অনেকে বলে, “ভাই, আমি জীবনে ঘুষ খেয়েছি। অফিসের টাকা মেরেছি। পরীক্ষায় নকল করে পাশ করেছি। দুই নম্বর সার্টিফিকেট বানিয়ে চাকরিতে ঢুকেছি। হলের বন্ধুদের সাথে রাতের বেলা ‘ইয়ে’ করেছি। আপনি জানেন না আমি কত খারাপ কাজ করেছি জীবনে। আমাকে আল্লাহ আর ক্ষমা করবেন না। তারচেয়ে মদটদ খেয়ে বাকিটুকুও করে করে ফেলি।” — না, আশা ছেড়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। বনী ইসরাইলের কত ভয়াবহ অপরাধ আল্লাহ تعالى ক্ষমা করে দিয়েছেন, সেটা আমরা এর আগের আয়তেগুলোতেই পড়েছি। এরপরও তিনি যদি তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে পারেন, তাহলে আমরাও ক্ষমা পাওয়ার আশা করতে পারি। আল্লাহ تعالى হচ্ছেন غفور (গা’ফু-র) অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি غافِر (গা’ফির) বা শুধুই ক্ষমাশীল নন। গাফু-র-এর লম্বা ‘-উর’ এর অর্থ হচ্ছে ‘অত্যন্ত’ ক্ষমাশীল।  ঠিকভাবে তওবা করে, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে, বাকি জীবন সেই পাপের পুনরাবৃত্তি না করার জন্য দৃঢ় শপথ নিলে, আল্লাহ تعالى আমাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি কু’রআনেই বহুবার দিয়েছেন। বরং ভয় ও ক্ষমার প্রত্যাশা —এ দুয়ের মাঝেই ঈমান।

আমরা যখনই ভালো হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব, শয়তান আমাদেরকে বহুবার বলবে, “তুমি! তোমাকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? যেই কয়দিন বেঁচে আছ, মৌজমাস্তি করে নাও। আর সুযোগ পাবে না।” — কিন্তু না। আমাদেরকে বার বার মনে রাখতে হবে: আল্লাহ تعالى হচ্ছেন গা’ফুরুর রাহিম — অত্যন্ত ক্ষমাশীল, নিরন্তর করুণাময়। তওবার সঠিক পদ্ধতি এবং শর্ত অনুসরণ করলে আমরা ক্ষমা পাওয়ার আশা সবসময় রাখতে পারি।[১০] আল্লাহ تعالى এতটাই ক্ষমাশীল যে, আন্তরিকতার সাথে ক্ষমা চাইলে তিনি শুধু ক্ষমাই করে দিবেন না, বরং খারাপ কাজগুলোকে ভালো কাজ দিয়ে বদলে দিবেন। অর্থাৎ, যে যত বেশি পাপী, তওবা করে ভালো হয়ে গেলে আল্লাহর تعالى কাছে সে তত বেশি প্রিয় হবে! শয়তান আমাদেরকে যা বুঝায়, বাস্তব হলো ঠিক তার উল্টো!

এই আয়াতের শেষটা আমাদের জন্য একটা সাবধান বাণী: আমাদের এত অবাধ্যতা, এত অকৃতজ্ঞতা — যদি আমাদের উপর আল্লাহর تعالى অসীম অনুগ্রহ এবং দয়া না থাকত:

لَكُنتُم مِّنَ ٱلْخَٰسِرِينَ

তাহলে তোমরা অবশ্যই সব হারিয়ে ফেলতে।

خَٰسِرِين (খাসিরিন) এসেছে خسر থেকে যার অর্থ: ১) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, ২) হেরে যাওয়া, ৩) যা দেওয়া উচিত, তার কম দেওয়া, ৪) ওজনে কম দেওয়া।[১৫০] যারা কিয়ামতের দিন হেরে যাবে, যাদের ভালো কাজগুলোর ওজন খারাপ কাজের ওজন থেকে কম হয়ে যাবে, তারা হবে খাসিরিন। এরা সেদিন হবে সর্বহারা, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। দুনিয়ায় এদেরকে দেখে যতই সুখী, যতই জীবনটা উপভোগ করছে মনে হোক না কেন, কিয়ামতের দিন তারা সবকিছু হারিয়ে ফেলে হাহাকার করতে থাকবে।

যদি আমাদের ভালো কাজগুলোকে আল্লাহ تعالى অনুগ্রহ করে কোনোটা ১০ গুণ, ১০০ গুণ, ১০০০ গুণ বাড়িয়ে না দেন, তাহলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাদের একটা নামাজও তখন কাজে লাগবে না, কারণ নামাযে দাঁড়িয়ে আমরা চাকরি, বাজার, রান্না, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা — এমন কোনো চিন্তা নেই, যেটা করি না। আমাদের যাকাতগুলোর আর কোনো মূল্য থাকবে না, কারণ আমরা যত ভাবে পারি সম্পদের পরিমাণ কম হিসাব করে, তার ২.৫% এর একটু কম নিয়ে, যাদেরকে যাকাত দিলে সবচেয়ে বেশি নাম হবে, তাদেরকে যাকাত দেই। আমাদের রোজাগুলো মূল্যহীন হয়ে যাবে, কারণ রোজা রেখে আমরা মিথ্যা বলি, হিন্দি সিরিয়াল দেখি, ইফতারের আগে খালি পেটে ঘুষ খাই।

এই ধরণের জেনেশুনে, বার বার অবাধ্যতার ফলাফল ভয়াবহ—

তোমরা তো জানোই, তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের ব্যাপারে নিষেধ ভেঙ্গেছিল, ওদের কী হয়েছিল। আমি ওদেরকে বলেছিলাম, “বানর/গরিলা হয়ে যাও তোমরা !  বিশ্রী-বিতাড়িত-ঘৃণিত!” [আল-বাক্বারাহ ৬৫]

এই ঘটনাটি ঘটে দাউদ عليه السلام  এর সময়কার বনী ইসরাইলিদের একটি গ্রামে।[৮][১১] সেই গ্রামে অধিবাসীরা ছিল বেশিরভাগ জেলে। তাদের কাছে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে নির্দেশ আসে: তারা সপ্তাহে ছয়দিন জীবিকার জন্য কাজ করতে পারবে, কিন্তু ‘সাবাত’ বা শনিবার কোনো জীবিকার জন্য কাজ করা যাবে না। এই দিনটা পুরোটাই তাদেরকে বিশ্রাম এবং আল্লাহর تعالى ইবাদতে পার করতে হবে। আজকাল ইহুদীদের মধ্যেও শনিবার একটি পবিত্র দিন এবং এদিন তারা বিশ্রাম এবং ইবাদতে পার করে।[৬][৪]

আল্লাহ تعالى তাদেরকে একটি ঈমানের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সাবাতের দিন সমুদ্রের মাছগুলো এসে পানি থেকে মাথা বের করে উঁকি দিত। কিন্তু সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে মাছ সহজে খুঁজে পাওয়া যেত না। জেলেরা প্রতি শনিবার সারাদিন বসে বসে দেখত: সমুদ্রের মাছগুলো একদম তাদের হাতের নাগালে এসে ছোটাছুটি করছে। তারা হাত বাড়ালেই মাছ ধরতে পারে। কিন্তু না, নিষেধ আছে: সেদিন কোনো মাছ ধরা যাবে না।[১][৬] এভাবে প্রতি শনিবার তাদেরকে ঈমানের পরীক্ষা দিতে হতো।

একসময় কিছু জেলে আর লোভ সামলাতে পারলো না। তারা একটা বুদ্ধি বের করল: শুক্রবার তারা জাল ফেলে রাখত। শনিবার মাছ এসে সেই জালে আটকা পড়ে যেত, আর পালিয়ে যেতে পারত না। তারপর রবিবারে তারা জালে আটকে থাকা মাছ তুলে ফেলত। এভাবে তারা যুক্তি দেখাল যে, তারা যেহেতু শনিবারে কোনো মাছ ধরছে না, তাই তারা সাবাতের নিয়ম ভাঙছে না।[৬]

আজকের যুগের মুসলিমদেরকেও একই ধরনের চালাকি করতে দেখা যায়, যেখানে তারা শারী’আহকে নিজের মতো বুঝে নিয়ে, নিজেরাই হিসাব করে বের করে কীভাবে জান্নাতে যাওয়া যায়। যেমন—

বনী ইসরাইলের সেই গোত্রের ভণ্ডামির শাস্তি ছিল ভয়ংকর:

فَقُلْنَا لَهُمْ كُونُوا۟ قِرَدَةً خَٰسِـِٔينَ

… আমি ওদেরকে বলেছিলাম, “বানর/গরিলা হয়ে যাও তোমরা ! বিশ্রী-বিতাড়িত-ঘৃণিত!”

বনী ইসরাইলের গোত্রের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়ে গিয়েছিল যে, এইভাবে চালাকি করাটা ঠিক হচ্ছে কিনা। তাদের মধ্যে একটি দল, যারা নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর تعالى বাণী মেনে চলতো, তারা বার বার সেই জেলেদেরকে মানা করেছিল এই ধরনের ভণ্ডামি না করতে। কিন্তু তারা শুনল না। তখন সেই নিষ্ঠাবান দলটি আলাদা হয়ে গ্রামের অন্য জায়গায় গিয়ে থাকা শুরু করল। কিন্তু একদিন তারা খেয়াল করল, ওই ভণ্ডদের জায়গা থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কৌতূহলী হয়ে সেখানে গিয়ে দেখল: ভণ্ড লোকগুলো সবাই বানরে/গরিলাতে পরিণত হয়েছে![১][৪]

চিত্র: এপ – বানর শ্রেণীর প্রাণী।

এখানে মতবিরোধ আছে যে, তারা সত্যিই শারীরিকভাবে বানর/গরিলা হয়েছিল, নাকি মানসিকভাবে বানর ধরনের হয়ে গিয়েছিল। প্রাণীজগতে বানর হচ্ছে শারীরিকভাবে মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রাণী। কিন্তু বানরের সাথে মানুষের একটা বড় পার্থক্য হলো: বানরের যখনই কিছু করতে ইচ্ছা করে, সে সেটা সাথে সাথে করে ফেলে। যেমন: বানরের ক্ষুধা পেলে, সে সামনে খাবার পেলেই খেয়ে ফেলে। কিন্তু একজন মানুষ খাবার আগে চিন্তা করে খাবারটা হালাল/বৈধ কিনা। একজন পুরুষ বানর অন্য একজন স্ত্রী বানরকে দেখলেই সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু একজন মানুষ প্রথমে চিন্তা করে: তার এগিয়ে যাওয়াটা সমাজ বা ধর্ম সমর্থন করে কিনা, বা ব্যাপারটা শালীন হবে কিনা। মানুষের এই বিশেষ গুণগুলোই তাকে সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণীর মর্যাদা দিয়েছে। কোনো মানুষ যখন এই গুণগুলো হারিয়ে ফেলে, তখন তাদের সাথে বানরের আর কোনো পার্থক্য থাকে না।

আল্লাহ শুধু বলেননি “বানর হও”, তিনি এর সাথে বলেছেন خَٰسِـِٔين (খাসিইন) হয়ে যাও। خاسﺋى (খাসিঈ) সাধারণত একটা কুকুর, শুকর বা শয়তানকে বলা হয়। এটা এমন একটা কিছু যাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, ঘৃণা করা হয়, মানুষের কাছে আসতে দেওয়া হয় না। একটা জঘন্য, ঘৃণিত, বিতাড়িত কিছু।[১০]

এই আয়াত পড়ে কিছু মুসলিম মনে করেন, “ইহুদীরা হচ্ছে বানর তুল্য। তাদেরকে গালিগালাজ করা যায়। কু’রআনে আল্লাহই تعالى ওদেরকে গালি দিয়েছেন, আর আমরা দিব না?”

দাবিটা হাস্যকর। কারণ এখানে আল্লাহ تعالى সব ইহুদিদেরকে গালি দেননি, বরং একদল ইহুদী, যারা সাবাতের নিষেধ ভেঙ্গেছিল, তাদেরকে বানর/গরিলা বানিয়ে দেন। সব ইহুদীদের বেলায় এটা প্রযোজ্য নয়। বরং সেই বনী ইসরাইল গ্রামের মধ্যে একদল ছিল, যারা ঠিকই সেই জেলেদেরকে বার বার মানা করেছিল, যেন তারা সাবাতের নিয়ম না ভাঙ্গে। কু’রআনেই সেই ঘটনা বলা আছে। সেই বনী ইসরাইলিরা ছিল সেই যুগের নিষ্ঠাবান মুসলিম।[১]

একইভাবে আজকে আমরা চিড়িয়াখানায় গিয়ে বানর/গরিলা দেখে বলব না, “ওই দেখো, ব্যাটা ইহুদী।” আজকের যুগের বানর, গরিলা, শূকরের সাথে ওই সব রূপান্তরিত বনী ইসরাইলিদের কোনোই সম্পর্ক নেই। এই প্রাণীগুলো তাদের আগেও পৃথিবীতে ছিল। এছাড়াও আলেমদের মত হচ্ছে: ওই সব রূপান্তরিত বনী ইসরাইল আর বংশবিস্তার করতে পারেনি। সেই প্রজন্মের পরেই তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।[৪]

বনী ইসরাইলের সেই গোত্রটি এমন এক ভয়ংকর কিছুতে পরিণত হয়েছিল যে, আল্লাহ تعالى নিজেই বলেছেন—

এভাবে আমি ওদেরকে এক ভয়ংকর দৃষ্টান্তে পরিণত করলাম সেই সময়কার মানুষদের জন্য এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। যারা আল্লাহর প্রতি সচেতন, তাদের সবার জন্য এটা একটা শিক্ষা নেওয়ার মতো ঘটনা। [আল-বাক্বারাহ ৬৬]

আল্লাহ تعالى বনী ইরসাইলের সেই গোত্রকে এমন এক ভয়ংকর রূপে পরিণত করলেন, যা দেখে অন্যান্য গোত্র এবং তাদের পরবর্তী বংশধর শিক্ষা পেয়ে গিয়েছিল। আশেপাশের মানুষ এসে তাদেরকে সেই রূপে দেখত, আর বুঝতে পারত আল্লাহর تعالى বাণী নিয়ে মশকরা করার ফলাফল কী ভয়াবহ। نكال (নাকাল) হচ্ছে এমন এক দৃষ্টান্ত, যা দেখে মানুষ ভয় পেয়ে সাবধান হয়ে যায়।[১][৫][১৪৯] যেমন, একদিন শিক্ষক এসে হোমওয়ার্ক না করার জন্য একজন ছাত্রকে ডেকে বললেন, “আজকে স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত মাঠের মাঝখানে গিয়ে কানে ধরে, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকো।” সাথে সাথে ক্লাসের সব ছাত্র বুঝে গেল কালকে থেকে হোমওয়ার্ক না করলে সর্বনাশ! শুধু সেই ক্লাসই না, পুরো স্কুলের সব ক্লাসের ছাত্ররা তাকে সারাদিন মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কানাঘুষা করে জেনে গেল এই ভয়ংকর শাস্তির পেছনে ঘটনা কী। পরদিন থেকে আশেপাশের ক্লাসের ছাত্ররাও নিয়মিত হোমওয়ার্ক করা শুরু করে দিল। এটা হলো نكال (নাকাল)।

আল্লাহ تعالى শুধু এখানেই শেষ করে দিলে আমরা বেঁচে যেতাম। কিন্তু আয়াতের শেষটি আমাদের জন্য ভয়ংকর:

যারা আল্লাহর প্রতি সচেতন, তাদের সবার জন্য এটা একটা শিক্ষা নেওয়ার মতো ঘটনা।

এই অংশটুকু আপনার-আমার জন্য। বনী ইসরাইলের সেই দলকে তিনি শাস্তি হিসেবে বানর/গরিলা বানিয়ে দিয়েছিলেন, তার মানে এই না যে, আমরা বেঁচে গেছি। বরং এই আয়াতে তিনি আমাদেরকেও সাবধান করে দিচ্ছে যে, আমরা যারা আল্লাহর প্রতি সচেতন, তাদের জন্য এটি একটি শিক্ষা নেওয়ার মতো ঘটনা। مَوْعِظَة (মাওইযাহ) এসেছে وعظ থেকে, যার অর্থ সাবধানবাণী বা সাবধান করার মতো ঘটনা, যা থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়।[১৪৮]

আজকে আল্লাহ تعالى মুসলিমদেরকে বানর/গরিলা বানিয়ে দৃষ্টান্ত দেন না। কিন্তু আমাদের চারপাশে অনেক পরিবার আছে, যাদেরকে দেখলেই আমরা বুঝতে পারি: আল্লাহকে تعالى রাগানোর ফলাফল কী ভয়াবহ। আমাদের চারপাশে কিছু পরিবারে দেখা যায় ছেলে প্রায়ই ড্রাগ নিয়ে, হোটেলে রাত কাটিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে জেলে যায়। তারপর বাবা-মা উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াদৌড়ি করে এলাকার চেয়ারম্যান, নেতাকে ধরে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনেন। খোঁজ নিলে দেখা যায়, বাবা এক বিরাট ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা, যার গুলশান-বনানীতে কয়েকটা বাড়ি আছে। সম্পদের লোভে সে শত পরিবারের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। এখন তার প্রতিরাতে হুইস্কি খেয়ে মাতাল না হলে কোনোভাবেই ঘুম আসে না। সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট এসেছে: তার লিভার সিরোসিস ধরা পড়েছে।

আবার কিছু পরিবারে দেখা যায়, কারো স্ত্রী ভয়ংকর জটিল সমস্যায় আক্রান্ত। তাকে কয়েক সপ্তাহ পর পর উত্তরার অত্যাধুনিক হাসপাতালে নিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করিয়ে আনতে হয়। খোঁজ নিলে দেখা যায়, স্বামী কনট্রাক্টর। কোটি কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট হাতিয়ে কয়েকটা বাড়ি, গাড়ি, জমির মালিক হয়ে গেছে। এখন স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা যোগার করতে গিয়ে সেগুলো একটার পর একটা বিক্রি করতে হচ্ছে। সে মানুষের কাছ থেকে যত সম্পত্তি হারামভাবে হাতিয়ে নিয়েছিল, তার সব এখন মানুষের কাছে ফেরত চলে যাচ্ছে।

এই ধরনের পরিবারগুলো হলো আমাদেরকে দেখানোর জন্য ভয়ংকর দৃষ্টান্ত نكال (নাকাল), এবং যারা আল্লাহর প্রতি সচেতন, যারা সত্যকে খুঁজে পাবার এবং জানবার ব্যাপারে সচেতন: যারা مُتَّقِين (মুত্তাক্বীন), তাদের জন্য শিক্ষা নেওয়ার মতো ঘটনা مَوْعِظَة  (মাওইযাহ)।

সূত্র

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version