কুরআনের কথা

জেনে শুনে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিবে না —আল-বাক্বারাহ ১৮৮

আল্লাহ تعالى এর আগের আয়াতে আমাদেরকে রোজা রেখে তাকওয়া অর্জন করার কথা বলছিলেন। এখন আসবে তাকওয়া অর্জনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা: আমরা কীভাবে সম্পদ ভোগ করি। কারণ মসজিদে বসে তাকওয়া দেখানো অনেক সোজা কাজ। কিন্তু মসজিদ থেকে বের হয়ে যখন আমরা চাকরি করি, ব্যবসা করি, সরকারি প্রজেক্ট হাতাই, কর্মচারীর বেতন দেই — তখন দেখা যায় আমাদের তাকওয়া আসলে কতখানি।


তোমরা মিথ্যা দিয়ে একে অপরের সম্পদ ভোগ করবে না। জেনে শুনে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিবে না। [আল-বাক্বারাহ ১৮৮]

মানুষের তাকওয়ার পরীক্ষা তখনি হয়, যখন সে কোনো ধর্মীয় পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে দুনিয়ার প্রলোভনের মুখোমুখি হয়। জায়নামাজে বসে নামাজ পড়ার সময় আমাদের সামনে কোনো প্রলোভন থাকে না। কিন্তু চোখের সামনে যখন নগদ টাকা চলে আসে, তখনি দেখা যায় আমাদের তাকওয়া আসলে কতদূর।

তোমরা মিথ্যা দিয়ে একে অপরের সম্পদ ভোগ করবে না

এই একটি বাক্য দিয়ে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যাবতীয় ছলচাতুরি, ধোঁকাবাজি, ফাঁকিবাজি, দুই নম্বরি পদ্ধতি সব বাতিল করে দিয়েছেন। সাড়ে আটটায় বাসা থেকে বের হয়ে যখন অফিসে নয়টার বদলে সাড়ে নয়টায় গিয়ে পৌঁছাই এবং বসের সামনে পড়ে বলি, “আজকে রাস্তায় এমন জ্যামে আটকে ছিলাম, জীবনেও এত জ্যামে পড়িনি।” — তখন আমরা মিথ্যা দিয়ে অফিসের সম্পদ ভোগ করি। সেই সম্পদ হচ্ছে আমার বেতন, যা অফিস আমাকে দিচ্ছে। তেল নিয়ে যখন রশিদে বেশি করে লিখে দিতে বলি, যেন অফিস থেকে বেশি টাকা তুলতে পারি, তখন মিথ্যা দিয়ে অফিসের সম্পদ ভোগ করি। অফিসে কাজের সময় ৯-৫টা, কিন্তু এর মধ্যে যখন এক ঘণ্টা ফেইসবুক, এক ঘণ্টা ইউটিউব, লিঙ্কড ইন, টুইটার, ব্যক্তিগত ইমেইল, এক ঘণ্টা ফোনে গল্প, তিন বার চা খেতে আরও এক ঘণ্টা, লাঞ্চের সময় বিরতি থাকে আধা ঘণ্টা অথচ নামাজের নাম করে এক ঘণ্টা বিরতি নেওয়া, এরপরও কাজের ফাঁকে এক ঘণ্টা ইসলামিক আর্টিকেল পড়া —এসব করে দিন পার করি, তারপর মাস শেষে গিয়ে পুরো বেতন তুলে নিয়ে আসি, তখন আমরা মিথ্যা দিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করি। আমাদেরকে যদি ৯-৫টা অফিসে বসে কী করেছি তার হিসেব দিতে বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে ৩-৪ ঘণ্টা হবে কাজ, আর বাকি ৪-৫ ঘণ্টা থাকবে মিথ্যা আর মিথ্যা।

ব্যবসায়ে কত ভাবে মিথ্যা দিয়ে আমরা লাভ করি, তা নিয়ে বিরাট বই লেখা যাবে। ক্লায়েন্টকে কম কাজ করে দিয়ে যখন বেশি টাকা দিতে বলি, তখন মিথ্যা দিয়ে ক্লায়েন্টের সম্পদ ভোগ করি। আউটসোর্স কাজে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে যখন ৪৫ ঘণ্টার বিল পাঠাই, তখন মিথ্যা দিয়ে অন্যের  সম্পদ ভোগ করি। দোকানে বাটখারায় কারচুপি করে যখন কাস্টমারকে কম মাল দেই, বিদেশ থেকে মেয়াদ উত্তীর্ণ মাল এনে দেশের মানুষের কাছে বিক্রি করি, অনভিজ্ঞ কাস্টমার পেয়ে দশগুণ বেশি দাম চাই — তখন আমরা মিথ্যা দিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করি।

আমরা কখন মিথ্যা দিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করছি তা ধরার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিজেকে জিগ্যেস করা: আমাকে যে টাকা দিচ্ছে, সে যা ধরে নিয়েছে আমি করবো, আমি কি ঠিক তাই করছি? সে যদি সবসময় আমার পাশে বসে আমাকে দেখত, তাহলে কি আমি ঠিক একই কাজ করতাম?

জেনে শুনে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিবে না

এই একটা কাজে আমরা সবচেয়ে দক্ষ। অন্য যে কোনো জাতিকে ঘুষ কত প্রকার, কী কী, তা আমরা শেখাতে পারবো। সরকারি পর্যায়ে একদম উপর থেকে শুরু করে একদম নিচের কেরানি পর্যন্ত ঘুষ ছাড়া কাজ করে না। এমনকি হাজ্জে যাওয়ার সময় বিনা ঝামেলায় ইমিগ্রেশন পার পেতে হলে অনেক সময় পাসপোর্টের মধ্যে কয়েকটা নোট ঢুকিয়ে অফিসারকে দিতে হয়। আর পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের সময় পুলিশ বাসায় আসলে তাকে ঘুষ দেওয়াটা তো অনেকটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে।

কেউ দুই নম্বর মাল এনে ব্যবসা করছে। কয়েকদিন পর পর পুলিশ এসে ঝামেলা করছে। কোনো সমস্যা নেই, উপরের অফিসারকে ঘুষ দিয়ে দাও, আর পুলিশ আসবে না। কাস্টমস থেকে মাল ছাড়াতে মোটা অংকের কর দিতে হবে, কাস্টমস অফিসারকে ঘুষ খাওয়াও, মাল ছেড়ে দেবে। সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্ট পাওয়া দরকার, মন্ত্রীকে ঘুষ খাওয়াও, অন্য কেউ আর পাবে না। নিজের বাড়িতে জলদি পানি, বিদ্যুতের সংযোগ নেওয়া দরকার, সরকারি অফিসে গিয়ে কেরানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অফিসারকে ঘুষ খাওয়াও, অন্যদের আগে আমার বাড়িতে সংযোগ চলে আসবে, যদিও কিনা অন্যরা আমার আগে দরখাস্ত করেছিল। রাস্তায় সার্জন ধরেছে পুরনো গাড়ি থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য, সমস্যা নেই, ঘুষ দিয়ে দাও, পার পেয়ে যাবে। এভাবে আমরা চাকরি, ব্যবসা, বাড়ি, গাড়ি, জমি, পড়ালেখা সবজায়গায় অন্যকে টপকে নিজে বেশি সুবিধা পাওয়া জন্য, অন্যায়ভাবে কিছু আদায় করার জন্য নানাভাবে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে যাচ্ছি। এসব করে আমরা অন্যের হক মেরে দিচ্ছি। দেশের জনগণ তাদের প্রাপ্য সুবিধা, সম্পদ, সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আর আমরা অন্যায়ভাবে ফায়দা লুটছি। এই সব কিছুই আল্লাহ تعالى এক বাক্যের মধ্যে নিষেধ করে দিয়েছেন, “জেনে শুনে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিবে না।

আল্লাহ تعالى এই আয়াতে অন্যায়ভাবে বোঝাতে اِثْم ব্যবহার করেছেন। اِثْم  -কে বাংলায় ‘পাপ’, ‘অন্যায়’ অনুবাদ করা হয়। ইছম শুধু পাপই নয়, একই সাথে এটি হচ্ছে অন্তরের এমন এক অবস্থা, যা মানুষকে ভালো কাজ থেকে দূরে রাখে, খারাপ কাজ করতে উৎসাহ দেয় এবং এক সময় মানুষ আর নিজেকে পাপ থেকে দূরে রাখতে পারে না।[মুতারাদিফাতুল কুর’আন] যেমন, মদ খাওয়াকে আল্লাহ تعالى ইছম বলেছেন, কারণ মদ থেকে শুরু হয় আসক্তি, পরিবারে অশান্তি, পরিবার ভেঙে যাওয়া, সন্তানের বখাটে হয়ে নানা ধরনের অপরাধে ঝুঁকে পড়া। শুধুমাত্র ব্রিটেনেই বছরে ৬.৪ বিলিয়ন পাউন্ড নষ্ট হয় অ্যালকোহল জনিত অর্থনৈতিক ক্ষতিতে, ৭.৩ বিলিয়ন পাউন্ড অ্যালকোহল জনিত অপরাধ দমনে, ২.৭ বিলিয়ন পাউন্ড অ্যালকোহল আসক্ত মানুষদের চিকিৎসায়, এবং বছরে ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয় অ্যালকোহল জনিত অসুস্থতা ও অপরাধের কারণে! এক ইংল্যান্ডে অ্যালকোহলের কারণে যে পরিমাণ অর্থ নষ্ট হয়, তা দিয়ে পৃথিবীতে ১.৬ বিলিয়ন অভাবী মানুষের অভাব দূর করে দেওয়া যেত—আর কেউ কোনোদিন অভাবে না খেয়ে মারা যেত না।

কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করা اِثْم ইছম, কারণ এভাবে অন্যায়ভাবে ভোগ করা সম্পদ সহজে হজম হয় না। এই হারাম সম্পদ হজম করতে গেলে আরও অনেক হারাম কাজ করতে হয়। এভাবে একটার পর একটা পাপ থেকে পাপের চক্রের মধ্যে মানুষ আটকে যায়। শুধু তাই না, একবার যখন মানুষ কর্তৃপক্ষকে টাকা খাইয়ে অন্যায় সুবিধা পেয়ে যায়, তখন তার লোভ হয়ে যায়। তারপর থেকে সে বার বার চেষ্টা করে অন্যায় সুবিধা পাওয়ার।

যেমন, চৌধুরী সাহেব বিশাল পরিমাণের ঘুষ খাইয়ে একটা সরকারি প্রজেক্টের কন্ট্রাক্ট হাতালেন। এর জন্য তিনি মন্ত্রীকে গুলশানে দুইটা ফ্ল্যাট কিনে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন। তারপর ব্যাংকের লোণ নিয়ে জোগাড় করা সেই বিশাল অংকের ঘুষ, সুদ সহ শোধ করতে গিয়ে, এবং মন্ত্রীকে কথা দেওয়া দুইটা ফ্ল্যাটের টাকা উঠানোর জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্রজেক্টের অনেক টাকা এদিক ওদিক সরিয়ে ফেলতে হলো। দুই নম্বর সস্তা কাঁচামাল সরবরাহ করতে হলো। যোগ্য কনট্রাক্টরদের কাজ না দিয়ে অযোগ্য, সস্তা কনট্রাক্টরদের কাজ দিতে হলো। এরপর একদিন তার প্রজেক্ট ধ্বসে পড়ল। তার নামে ব্যাপক কেলেঙ্কারি হয়ে মামলা হয়ে গেলো। মামলায় উকিলের টাকা জোগাড় করতে তাকে আরও বিভিন্ন উপায়ে টাকা মারা শুরু করতে হলো। তারপর কয়েকদিন পর পর তাকে পুলিশ ধরতে আসে, আর তিনি পুলিশের উপরের তলার লোকদের ঘুষ খাইয়ে পুলিশকে হাত করে ফেলেন। প্রজেক্টে দুর্নীতির কারণে ভুক্তভুগি মানুষদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে অনেক টাকা খরচ করে কিছু ‘সোনার ছেলে’ পালতে হয়। তারা মাঝে মাঝেই খুন, ধর্ষণ করে, হোটেলে থেকে … করে এসে বিরাট বিল ধরিয়ে দেয়। তারপর তাদেরকে যখন পুলিশ ধরতে আসে, তিনি পুলিশকে টাকা খাইয়ে তাদেরকে রক্ষা করেন। এত দুশ্চিন্তার মধ্যে তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার জন্য তাকে নিয়মিত মদ খাওয়া ধরতে হয়। এভাবে একটার পর একটা পাপে তিনি জড়িয়ে পড়তে থাকেন। পাপের ধারাবাহিকতা তার জীবনটাকে ঘিরে ফেলে।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এই এক আয়াতে এমন এক অসাধারণ মূলনীতি শিখিয়ে দিয়েছেন, যা বাস্তবায়ন করলে আমাদেরকে বইয়ের পর বই আইন পড়তে হবে না। মানুষের তাকওয়াই যথেষ্ট হবে মানুষকে হারাম সম্পদ থেকে দূরে রেখে, সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণ, সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। একই সাথে এটি এমন একটি বাজার তৈরি করবে, যেখানে গ্রাহকরা ঠকবে না। বিক্রেতা এবং গ্রাহকের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। গ্রাহকরা নির্দ্বিধায় আরও বেশি করে পণ্য কিনবে। যার ফলে বিক্রেতারাই আরও বেশি লাভবান হবেন। সবচেয়ে বড় কথা: হারাম সম্পত্তি নিয়ে চাকুরীজীবী এবং ব্যবসায়ীরা আল্লাহর تعالى শাস্তিতে জর্জরিত হয়ে জীবন পার করবেন না। তারা সুস্বাস্থ্য, শান্তি, সম্মান নিয়ে নিজে এবং পরিবারকে নিয়ে আল্লাহর تعالى অসীম বরকতে জীবন পার করবেন। তারপর মৃত্যুর পরে গিয়ে পাবেন বিশাল পুরস্কার। সব দিকে থেকেই তারা জয়ী হবেন। শুধু দরকার এই জীবনে একটু লোভ সামলানো, নিজের বিবেককে আরও শক্ত করা এবং ‘অন্যরাও করে, তাই আমিও করি’ —এই চিন্তা করে গা ভাসিয়ে না দেওয়া।

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version