কুরআনের কথা

সে শুধুই তোমাদেরকে জঘন্য এবং অনৈতিক কাজ করতে বলে — আল-বাক্বারাহ ১৬৯

2_169_title

সে শুধুই তোমাদেরকে জঘন্য এবং অনৈতিক কাজ করতে বলে, আর যেন তোমরা আল্লাহর تعالى সম্পর্কে না জেনে কথা বলো। [আল-বাক্বারাহ ১৬৯]

শয়তান কখনও আপনাকে এসে বলবে না, “আমি শয়তান। আমি তোমাকে জাহান্নামে পুড়াতে চাই। আসো আমরা … করি।” ইবলিস এবং অন্যান্য জিন শয়তানরা মানুষের কাছে অদৃশ্য প্রাণী। তারা বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’ বা ‘অন্য ডাইমেনশন’-এ থাকে, যেখান থেকে তারা ঠিকই আমাদেরকে দেখতে পায়, কিন্তু আমরা তাদেরকে দেখতে পাই না, বা কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্র দিয়ে সনাক্ত করতে পারি না।

সে এবং তার অনুসারিরা তোমাদেরকে তাদের জায়গা থেকে দেখতে পায়, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখতে পাওনা। [আল-আ’রাফ ৭:২৭]

শয়তান মানুষের অবচেতন মনে কুচিন্তা বা কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দেয়। আমরা সাবধানে লক্ষ্য করলেও বুঝতে পারবো না: আমাদের মনের গভীরে যে চিন্তাগুলো চলছে, তার কোনটা আমি, আর কোনটা শয়তান। সূরা আন-নাস-এ আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলেছেন, কীভাবে শয়তান কাজ করে—

(আমি আশ্রয় চাই) তার অনিষ্ট থেকে, যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে কুমন্ত্রণা দেয়। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। জ্বিনের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে। [আন-নাস  ১১৪:৪-৬]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, শয়তান শুধুই জ্বিন নয়। একইসাথে যে সব মানুষ ইবলিস এবং তার উদ্দেশকে বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করে, তারাও শয়তান।

শয়তান এমন কৌশলে আমাদের মনে কু-চিন্তা, অসুস্থ কামনা ঢুকিয়ে দেয় যে, আমরা মনে করবো: সেগুলো আসলে আমাদের নিজেদেরই চিন্তা-ভাবনা, আবেগ এবং অনুভুতি। যেহেতু আমরা সবসময় শয়তানের ব্যাপারে সাবধান থাকি না, তাই কখন যে শয়তান আমাদের মধ্যে তার কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দিয়ে, আমাদেরকে দিয়ে তার কাজ করানো শুরু করে দেয়, তা আমরা ভুলে যাই। একারণেই আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সাবধান করেছেন—

যারা আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকে, যখনি তাদের মনে শয়তান কোনো কু-চিন্তা দেয়, তারা সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তখনি তারা পরিস্কার দেখতে পায় আসলে কী ঘটছে।  [আল-আ’রাফ ৭:২০১]

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে একটা চমৎকার ফর্মুলা শিখিয়ে দিয়েছেন: কীভাবে শয়তানকে প্রতিহত করতে হবে। যখনি অনুভব করা শুরু করবেন যে, আপনি যেই কাজটা করছেন, তা করা ঠিক হচ্ছে না, সাথে সাথে আল্লাহর تعالى কথা মনে করুন। মনে মনে বুঝে বলুন, “আউ’যু বিল্লাহি মিনাশ শাইতা’নির রাজিম” – “আমি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই বিতাড়িত শয়তানের কাছ থেকে”। দ্রুত কোনো কু’রআনের আয়াত মনে করার চেষ্টা করুন, যেটা আপনার পরিস্থিতির সাথে মিলে যায়। যেমন: আপনি কারও প্রতি দুর্বলতা অনুভব করছেন, এমন দিকে তাকাচ্ছেন যেদিকে আপনার তাকানোর কথা না, সাথে সাথে নিজেকে মনে করিয়ে দিন—

বিশ্বাসী পুরুষদেরকে বলো যেন, তারা তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের গোপন অঙ্গকে সাবধানে রক্ষা করে, এটা তাদের জন্যই বেশি কল্যাণকর। আল্লাহ খুব ভালো করে জানেন তোমরা কী করো।  বিশ্বাসী নারীদেরকে বলো, যেন তারা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের গোপন অঙ্গকে সাবধানে রক্ষা করে … [নুর ২৪:৩০]

তবে দরকারের সময় জরুরি কোনো আয়াত মনে করাটা খুব কঠিন, যদি না আমরা নিয়মিত কিছু জরুরি আয়াত ঝালিয়ে না নেই। এজন্য নিয়মিত কু’রআন পড়াটা জরুরি। আর সবচেয়ে বেশি দরকার কু’রআন বুঝে পড়া। বুঝে কুর’আন না পড়লে আমরা কোনোদিন জানবো না: আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কত কথা বলেছেন, কত পদ্ধতি শিখিয়েছেন, কত ব্যাপারে সাবধান করেছেন।

আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে বলছেন যে, শয়তান আমাদেরকে ٱلْفَحْشَآء ফাহশা’ এর দিকে ডাকবে। ফাহশা’ হচ্ছে যে কোনো লজ্জাহীন, অশ্লীল এবং অনৈতিক কাজ, যেমন, বিপরিত লিঙ্গকে নিয়ে করা যাবতীয় অশ্লীল কাজ।[১১][১৬] ফেইসবুকে বিপরীত লিঙ্গের দিকে পশুর মত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। হিন্দি, ইংরেজি মুভি দেখা, যেখানে নারী পুরুষদের অশ্লীলভাবে দেখানো হয়। পরকীয়া এবং অশ্লীল আবেদনে ভরা হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা গান শোনা। সবশেষে একেবারেই পশুর থেকেও অধম হয়ে গিয়ে পর্ণ দেখা, সমকামিতা, ব্যভিচারে জড়িয়ে পড়া —এই সব কিছু ফাহশা’র মধ্যে পড়ে।

শয়তান জানে যে, আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কামনা। তাই এই দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর জন্য ওরা কোটি কোটি ডলারের বিশাল মুভি, মিউজিক, পর্ণ বাণিজ্য সাম্রাজ্য তৈরি করেছে। সকালে ঘুমের থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা যেন প্রতিক্ষণে ফাহশা’র কোনো না কোনো হাতছানি দেখতে পাই, সেজন্য ওরা খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, টিভি, রেডিও, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, রাস্তায় বিলবোর্ড —সব দখল করে রেখেছে। বিংশ শতাব্দীতে যোগাযোগের যত আধুনিক প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে, তার বেশিরভাগই আজকাল ওরা ব্যবহার করছে ফাহশা’র মধ্যে আমাদের বুঁদ করে রাখার জন্য।

ফাহশা’র একটি বৈশিষ্ট্য হলো: আমরা প্রথম যখন খারাপ কিছু দেখি, তখন চোখে খুব লাগে। কিন্তু যখন বার বার দেখতে থাকি, তখন আস্তে আস্তে চোখ সয়ে আসে। একসময় সেটা আর খারাপ লাগে না। একারণেই মিডিয়াতে ফাহশা’কে ধীরে ধীরে নোংরা থেকে নোংরাতর করা হয়। দেশে যখন কেব্‌ল টিভি প্রথম এসেছিল, আমরা তখন পাশ্চাত্যের অশালীন পোশাক, আচার-আচরণ দেখে বিরাট ধাক্কা খেয়েছিলাম। একসময় তা আমাদের সহ্য হয়ে গেল। এখন তাদের অশ্লীল সংস্কৃতি, ফ্যাশন আর আমাদের চোখে লাগে না। এভাবেই ফাহশা’ মানুষকে ধীরে ধীরে বেহায়া বানিয়ে দেয়।

শয়তানের মানুষকে ডোবানোর কিছু পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো—

আপনাকে ভুলিয়ে দিবে আপনার কী করা উচিত নয়

শয়তান আমাদেরকে প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘যাও, মাথা ভর্তি ফালতু সব জিনিসপত্র ঢুকাও, যেগুলো তোমার কোনো কাজে আসবে না।’ আমরা হয়তো বছরে একটা ভালো আর্টিকেল বা বই পড়লাম। কিন্তু তারপর শয়তান আমাদেরকে দশটা মুভি দেখিয়ে আমাদের ব্রেইনের কোটি কোটি নিউরন আবর্জনা দিয়ে ভরে ফেললো। এরপর যা কিছু ভালো শিখেছিলাম, তার কিছুই যেন মস্তিষ্কে অবশিষ্ট না থাকে, তার জন্য আরও বিশটা সিরিয়াল ঢুকিয়ে দিলো। এরপর থেকে আমরা যখনি একা বসে থাকি, বা রাতে বিছানায় শুতে যাই, আমাদের তখন আর আল্লাহর تعالى কথা মনে পড়ে না, বা কু’রআনের কোনো বাণী কানে বাজে না। বরং আমাদের কানে বাজে মুভির ডায়ালগ। চোখ বন্ধ করলে কোনো মুভির নাচ-গান বা মারামারির দৃশ্য ভেসে উঠে। আর মুখে কোনো হিন্দি বা ইংরেজি গান গুন গুন করতে থাকি।

তাই আমাদের চেষ্টা করতে হবে: শয়তান যেন আমাদেরকে ভালো কথা, ভালো উপদেশ, কু’রআনের বাণী ভুলিয়ে দিতে না পারে। একারণেই আল্লাহ আমাদেরকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ বুঝে শুনে, গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তে বলেছেন, যাতে করে আমরা ভালো জিনিসগুলো ভুলে না যাই। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারি না, কারণ শয়তান আমাদেরকে—

বিনোদনে ডুবিয়ে রাখে

এই যুগের প্রজন্মের এক ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিয়েছে, যেটা আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন এতটা খারাপ অবস্থা ছিল না। আজকালকার কিশোর, তরুণরা বাসায় এসে ঘণ্টা খানেক মোবাইল ফোনে গেম খেলে। তারপর ঘণ্টা খানেক এক্সবক্স/প্লেস্টেশন/নিন্টেন্ডো-উই। তারপর ঘণ্টা খানেক টিভি। তারপর ঘণ্টা খানেক ফেইসবুক, ইউটিউব। তারপর ঘণ্টা খানেক মোবাইলে বন্ধু-বান্ধবের সাথে বেহুদা আড্ডা মারে। এই সব শেষ হলে ঘুম, পরের দিন স্কুল/কলেজ/চাকরি এবং বাসায় এসে আবারো সেই মোবাইল ফোন, ভিডিও গেম, টিভি, কম্পিউটার, ফোনের চক্র।

আগের প্রজন্মের যেমন মাদকাসক্তি ছিল, সেরকম আজকের প্রজন্মের জন্য ‘বিনোদনাসক্তি’ মহামারির আকারে পৌঁছেছে। একদিন টিভি না দেখে এরা থাকতে পারে না। সকালে, বিকালে, রাতে কখন ফেইসবুকে যাবে, তার জন্য জান আকুপাকু করতে থাকে। মোবাইল ফোন নষ্ট হয়ে গেলে এরা ডিপ্রেশনে চলে যায়।

আজকাল আর শয়তানদেরকে বেশি কষ্ট করতে হয় না। মানুষ নিজেই নিজেকে ধ্বংস করার জন্য এত ব্যবস্থা করে ফেলেছে যে, শয়তানরা শুধু আরামে বসে দেখতে থাকে: কীভাবে একজন বাবা-মা তার সন্তানদেরকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়ে শয়তানের কাজ করে দিচ্ছে। কীভাবে বাবা-মারা সমাজে নাক উঁচু রাখার জন্য সন্তানদেরকে ভিডিও গেম কিনে দিয়ে খুনাখুনির, ব্যভিচারের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এরপর মনুষ্যত্ব যাও বা বাকি থাকতো, সেটা শেষ করতে সন্তানদের নিজের ঘরে যা খুশি করার জন্য ব্যক্তিগত কম্পিউটার এবং অবাধ ইন্টারনেটের সংযোগ দিয়ে দিচ্ছে। মানবজাতিকে নৈতিকভাবে ধ্বংস করে মানুষরূপী শয়তান দিয়ে পৃথিবী ভরিয়ে ফেলার যে মহাপরিকল্পনা শয়তানদের রয়েছে, তা বাস্তবায়নে আজকাল বোকা মানুষরাই নিয়মিত নিষ্ঠার সাথে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে যাচ্ছে।

আজকাল টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ভিডিও গেম ছাড়া মানুষ নিজেদেরকে খ্যাঁত,  ছোট মনে করে। মাত্র ৩০ বছর আগেও এগুলোর কোনোটাই ছিল না। কিন্তু আজকাল এগুলো না থাকলে এমন অবস্থা হয় যে, মানুষ নিজেদেরকে সমাজের নিচু শ্রেণীর মনে করা শুরু করে। এর কারণ হল শয়তানের আরেকটি অন্যতম কৌশল—

আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে না দেয়া

আল্লাহ যখন শয়তানকে তার সান্নিধ্য থেকে বের করে দিচ্ছিলেন, তখন শয়তান একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শপথ করেছিল, যা থেকে তার মানুষকে ধ্বংস করার অন্যতম একটি প্রধান পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়—

(শয়তান বলল) “আমি মানুষের কাছে আসব ওদের সামনে থেকে, ওদের পেছন থেকে, ওদের ডান দিক থেকে এবং ওদের বাম দিক থেকে। আপনি দেখবেন ওরা বেশিরভাগই কৃতজ্ঞ না। [আল-আ’রাফ ৭:১৭]

কু’রআনে আল্লাহ প্রায় ৬০টি আয়াতে কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন। এর মধ্যে একটি বিখ্যাত আয়াত হলো—

মনে করে দেখো, তোমাদের প্রভু কথা দিয়েছিলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো। কিন্তু যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও…, আমার শাস্তি বড়ই কঠিন। [ইব্রাহিম ১৪:৭]

এখানে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কথা দিয়েছেন যে, যদি আমরা কৃতজ্ঞ হই, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে দিতেই থাকবেন। তিনি আরবিতে তিনবার জোর দিয়ে একথা বলেছেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো, দিতেই থাকবো, দিতেই থাকবো।”[১]

নিশ্চয়ই শয়তান চাইবে না আপনি জীবনে আরও বেশি পান, আরও ভালো থাকেন। একারণে শয়তানের সবসময় চেষ্টা থাকে: কীভাবে আপনাকে অসুস্থ বিনোদনে বুঁদ করে রাখা যায়, যেই বিনোদন আপনাকে কখনই পরিতৃপ্তি দেয় না। কীভাবে আপনাকে ভুলিয়ে দেওয়া যায় যে, আল্লাহর تعالى অনুগ্রহে আপনি জীবনে কত কিছুই না পেয়েছেন।

কেন আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কৃতজ্ঞ হতে বলেন? তাঁর তো আমাদের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই। আমরা কৃতজ্ঞ হই আর না হই, তাতে তো তাঁর কোনো লাভ নেই। তাহলে কৃতজ্ঞ হয়ে কী লাভ?

(চলবে, দ্বিতীয় পর্ব)

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version