কুরআনের কথা

এসবের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের জন্য অবশ্যই বিরাট নিদর্শন রয়েছে — আল-বাক্বারাহ ১৬৪ — ২য় পর্ব

2_164_title2

প্রথম পর্বে দেখানো হয়েছে: আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে কেউ যদি গভীরভাবে ভেবে দেখে, সে দেখবে যে, এসবের সৃষ্টির মধ্যে একই মূলধারার ডিজাইন লক্ষ্য করা যায়, একজন স্রষ্টারই স্বাক্ষর স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে। একইভাবে কেউ যদি দিন-রাতের পরিবর্তন নিয়ে ভেবে দেখে: কীভাবে দিন-রাতের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন হয়, কেন রাতের আকাশে অন্ধকার থাকে, কীভাবে প্রতি বছর একই দৈর্ঘ্যের দিনরাত হয়, তাহলে সে দেখবে এটা বিশেষভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যেন মানুষের মতো জটিল প্রাণ একদিন পৃথিবীতে আসতে পারে।

তারপর কেউ যদি পানিতে ভেসে চলা জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে: কীভাবে এত ভারি একটা জিনিস পানিতে ভেসে আছে, তাহলে সে দেখবে: পানির এক বিশেষ গুণ ‘প্লবতা’র কারণেই তা হয়। যদি এই বিশেষ গুণ পানিতে দেওয়া না হতো, তাহলে সভ্যতা গড়ে উঠত না, কোনো প্রাণী পানিতে ভেসে থাকতে পারতো না। প্রাণী জগৎ কখনই আজকে এই পর্যায়ে আসতে পারতো না। কেউ একজন ইচ্ছে করে এই ব্যাপারগুলো নির্ধারণ করেছেন দেখেই আজকে মানুষ পৃথিবীতে বাস করতে পারছে, এত বৈচিত্র্যের উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগৎ হতে পেরেছে, পৃথিবী মানুষের বসবাসের জন্য এত আরাম দায়ক হয়েছে।

এবার আয়াতের বাকি নিদর্শনগুলো নিয়ে দেখি—

৪) আকাশ থেকে আল্লাহর পাঠানো পানিতে

মেঘ কমপক্ষে ১.২ কিলোমিটার উঁচুতে থাকে। যদি এত উঁচু থেকে পানির ফোঁটা ফেলা হয়, তাহলে মধ্যকর্ষণ শক্তির কারণে পানির কণাগুলো বন্দুকের গুলির মতো দ্রুত বেগে, ঘণ্টায় প্রায় ৫৫২  কিলোমিটার বেগে মাটিতে আঘাত করার কথা। আকাশ থেকে প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটা যদি বুলেটের মতো দ্রুত গতিতে আমাদের উপর পড়তো, তাহলে প্রতিবার বৃষ্টি হওয়ার পর লোকালয়গুলো ধ্বংস হয়ে গুড়া গুড়া হয়ে যেত। কিন্তু সেটা হয় না দুটো কারণে— ১) বাতাসের ঘর্ষণের কারণে পানির ফোঁটাগুলোর গতি কমে যায়, আর ২) পানির ফোঁটা গুলো পড়ার সময় প্যারাসুটের মতো আকৃতি নেয়, যার কারণে তার গতি আরও কমে যায় এবং সেটি ছোট ছোট কণায় ভাগ হয়ে পৃথিবীতে পড়ে। বৃষ্টির পানির ফোঁটার এই বিশেষ আকৃতিটি এতটাই কাজের যে, আজকাল আধুনিক প্যারাসুট তৈরি করা হচ্ছে পানির ফোঁটার এই বিশেষ আকৃতি অনুকরণ করে। যদি পানির ফোঁটাগুলো প্যারাসুট আকৃতি নিয়ে ধীরে সুস্থে না পড়তো, তাহলে বৃষ্টির পানি প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে পড়ে গাছ পালা জখম হয়ে যেত, অনেক প্রাণী মারা যেত।[৩০২]

পৃথিবীর তিনভাগের দুইভাগ পানিই আছে সমুদ্রে। বিশাল সব লবণাক্ত পানির আধার, অথচ তা স্থলচর প্রাণী এবং উদ্ভিদের জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য। আল্লাহ تعالى প্রকৃতিতে সমুদ্রের বিশাল পরিমাণের পানিকে বিশুদ্ধ করে মিঠা পানি তৈরি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যেন উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের জন্য পানির অভাব না হয়। এই পদ্ধতি হচ্ছে পানির চক্র। সমুদ্রের তাপে পানি বাষ্প হয়ে আকাশে উঠে যায়, তারপর শীতল হয়ে মেঘ তৈরি হয়। সেই মেঘ সমুদ্রেই বসে না থেকে, বাতাসের ধাক্কায় নির্দিষ্ট কিছু পথে স্থলে এসে বৃষ্টি হয়ে নদী-নালা, খাল-বিল, ভূগর্ভে পানির আধারে মিঠা পানি সরবরাহ করে। সেই পানি আমরা পান করি, শস্য ক্ষেত হয়, গাছ পালা হয়, কোটি কোটি প্রাণী পানি পান করতে পারে। আমরা নদী-নালা, খাল-বিল যেখানেই যত মিঠা পানি দেখি না কেন, সব পানি কোনো না কোনো ভাবে এসেছে সমুদ্র থেকে।

৫) যা মৃত জমিকে আবার প্রাণ দেয়, এর মধ্যে সব ধরণের প্রাণীকে ছড়িয়ে দেয়

আল্লাহর এই বাণীর সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ দেখা যায় মরু অঞ্চলগুলোতে। বৃষ্টি হওয়ার আগে সেখানকার মাটি থাকে শুকনো, প্রাণ শূন্য—

মৌসুমি বৃষ্টি হওয়ার পর তা আবার জীবিত হয়ে উঠে—

এই অসাধারণ ঘটনাটি ঘটে শুধু বৃষ্টির পানির কারণেই নয়, এর মধ্যে আরেক বিরাট রহস্য রয়েছে।

বিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কার হয়েছে যে, মেঘ তৈরি হওয়ার অন্যতম মূল কারণ হলো, যখন সমুদ্রের পানি সমুদ্রের পাড়ে আছড়ে পড়ে, তখন এক ধরণের সাদা ফেনা তৈরি হয়। এই ফেনাগুলো বাতাসের ধাক্কায় স্প্রে আকারে মেঘে চলে যায়। একইসাথে এই ফেনার স্প্রের সাথে মাটি থেকে অনেক অণুজীব এবং রাসায়নিক পদার্থও মেঘে চলে যায়। মেঘগুলো যে শুধুই পানি বহন করছে তা নয়। সেই পানির সাথে মিশে আছে বিশাল পরিমাণের ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য অণুজীব। একইসাথে আছে মাটিকে উর্বর করার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি।[৩০৩]

একারণেই যখন মৃত জমিতে বৃষ্টি পড়ে, সেই মৃত জমি আবার সজীব হয়ে ওঠে। বৃষ্টির পানিতে যদি শুধুই বিশুদ্ধ পানি থাকতো, তাহলে তা হতো না। বৃষ্টির পানির মাধ্যমে পানি, অণুজীব, রাসায়নিক পদার্থের এক পুষ্টিকর মিশ্রণ বিপুল পরিমাণে মাটিতে সরবরাহ হয় দেখেই শুকনো, মৃত জমি আবার সজীব, প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারে।[৩০৩]

৬) বাতাসের পরিবর্তনে

বাতাস হলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গ্যাসের প্রবাহ। বাতাস প্রবাহ হওয়ার মূল কারণ বায়ুমণ্ডলে চাপের পার্থক্য। বাতাস সবসময় উচ্চ চাপ থেকে নিম্ন চাপের দিকে প্রবাহিত হয়। বায়ুমণ্ডলে চাপের পার্থক্য হয় দুটো কারণে, ১) তাপমাত্রার পার্থক্যর কারণে, এবং ২) পৃথিবীর নিজ অক্ষের উপর ঘোরার কারণে। পৃথিবীর উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর কাছে আসলে বাতাস ঠাণ্ডা এবং ভারি হয়ে নিচে নেমে যায়। আর পৃথিবীর বিষুবরেখার কাছাকাছি বাতাস আসলে তা গরম এবং হাল্কা হয়ে উপরে উঠে যায়। এভাবে ক্রমাগত বাতাস গরম এবং ঠাণ্ডা এলাকার মধ্যে ঘুরতে থাকে।[৩০৪]

পৃথিবীতে বিশেষ কিছু জায়গায় বাতাসের বিশেষ চক্র রয়েছে। এই চক্রগুলো ব্যবহার করে নদিতে পাল তোলা নৌকা চলে, সমুদ্রে পাল তোলা জাহাজ চলে। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে জাহাজ চলতে পারে বাতাসের এই বিশেষ প্রবাহগুলোকে কাজে লাগিয়ে। এই প্রবাহগুলো যদি না থাকতো, তাহলে নদিতে নৌকা, সমুদ্রে জাহাজ চলতো না। মানুষের সভ্যতা গড়ে উঠত না। নৌপথে মাল পরিবহণ করা সবচেয়ে কম খরচের এবং নৌবন্দরগুলো ঘিরেই বেশিরভাগ বড় বড় সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এসবই সম্ভব হয়েছে বাতাসের কারণে।[৩০৪]

বাতাসের প্রবাহের ফলে ক্ষয় হয়। মরুভুমি থেকে রাসায়নিক পদার্থ সমৃদ্ধ বালু, পাহাড়ের গায়ের রাসায়নিক পদার্থ সমৃদ্ধ মাটির আবরণ ক্রমাগত বাতাসের প্রবাহে ক্ষয় হয়ে মিহি গুড়োর আকারে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভেসে বেড়ায়। যেসব জায়গায় বিপুল পরিমাণে এই পুষ্টিকর ধুলা জমা হয়, সেই জায়গাগুলোর মাটি অত্যন্ত উর্বর হয় এবং সেখানে ফসল সবচেয়ে ভালো ফলে। এভাবে বাতাস সারা পৃথিবীর মাটিতে পুষ্টি বিতরণ করে বেড়ায়।[৩০৪]

আমাজন জঙ্গল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জঙ্গল। এই জঙ্গলের কোটি কোটি প্রজাতির গাছ পালা, লক্ষ প্রজাতির প্রাণী বাস করে। এরা মাটি থেকে যে বিপুল পরিমাণের পুষ্টি সংগ্রহ করে, তাতে অল্প সময়ের মধ্যেই মাটির সব পুষ্টি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না, কারণ হাজার মাইল দুরের আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরুভুমি থেকে বাতাসের মাধ্যমে রাসায়নিক পদার্থ সমৃদ্ধ বালু উড়ে এসে দক্ষিণ আফ্রিকা মহাদেশের আমাজন বনে জমা হয়। আফ্রিকা মহাদেশের মরুভূমি কয়েক হাজার মাইল দূরে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের এক বনে পুষ্টি যোগায়! এই সবই সম্ভব হয়েছে বাতাসের বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত পথের কারণে।[৩০৩]

বাতাসের প্রবাহের ফলে ফুলের রেণু, অনেক উদ্ভিদের বীজ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়িয়ে যায়। এর ফলে গাছ পালার বিস্তৃতি ঘটে। ফুল পরাগিত হয়ে ফল তৈরি হয়।[৩০৪] যদি বাতাস এভাবে বীজ না ছড়াত, তাহলে আজকে পৃথিবীতে এত শস্য ক্ষেত, বনজঙ্গল থাকতো না। এত ফুল পরাগিত হয়ে এত ফল তৈরি হতো না। আজকে আমরা যে হাজার হাজার প্রজাতির ফল খাচ্ছি, এত বিশাল পরিমাণের ফলের সরবরাহ পাচ্ছি, তার কারণ বাতাস।

৭) আকাশ এবং পৃথিবীর মাঝখানে মেঘের নিয়ন্ত্রিত চলাচলে

কোটি কোটি টন পানি নিয়ে কীভাবে মেঘ আকাশে ভেসে থাকে?

মেঘ তৈরি হয় সুক্ষ পানির কণা ঠাণ্ডায় জমে ঘন হয়ে একত্র হয়ে। যদিও মেঘ দেখে মন হয় যে সেগুলো কোনো ঘন পানির মিশ্রণ, কিন্তু আসলে মেঘের পানির কণাগুলোর মধ্যে অনেক দূরত্ব থাকে। মেঘের মধ্যে যতখানি পানি থাকে, তার থেকে হাজার গুন বেশি ফাঁকা জায়গা বাতাস ভরা থাকে। একারণে পানির কণাগুলো একসাথে জমে পানির ফোঁটা হয়ে পড়ে যায় না, যতক্ষণ না বৃষ্টি না হয়।

এছাড়াও মেঘের মধ্যে পানির কণাগুলো আসলে প্রতি মুহূর্তে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু একই সাথে বাতাসের উপরের দিকে প্রবাহের ধাক্কার কারণে কণাগুলো আবার উপরের দিকে ছিটকে যায়। আবার পড়া শুরু করে। আবার ধাক্কা খেয়ে উপরে উঠে যায়। এভাবে মেঘের ভেতরে পাণির কণাগুলো প্রতি মুহূর্তেই পড়ছে, আবার উঠছে। যদিও দূর থেকে দেখে মনে হয় যে, মেঘ স্থির হয়ে ভেসে আছে। কিন্তু আসলে মেঘের ভিতরে কোটি কোটি পানির কণা প্রতি মুহূর্তে পড়ছে এবং বাতাসের ধাক্কায় আবার উপরে উঠছে।

মেঘ হচ্ছে সারা পৃথিবীতে পানি বিতরণ করার এক অসাধারণ ব্যবস্থা। মেঘের মাধ্যমে সমুদ্র থেকে কোটি কোটি টন পানি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বন, জঙ্গল, মরুভুমি, শস্য ক্ষেতে পানি নিয়ে যায়। একইসাথে মেঘের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা উষ্ণ থাকে। মেঘের স্তর পৃথিবী থেকে মহাকাশে তাপ হারিয়ে যাওয়া আটকে রাখে, পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী আরামদায়ক তাপমাত্রায় রাখে। আবার ঘন মেঘের স্তর সূর্যের প্রখর আলো থেকে রক্ষা করে, মাটি অতি উত্তপ্ত হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে। মেঘ আছে দেখেই সারা পৃথিবী এখনো সূর্যের তাপে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়নি।

এসবের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের জন্য অবশ্যই বিরাট নিদর্শন রয়েছে

আল্লাহ আমাদেরকে এই আয়াতে শেখাচ্ছেন যে, যদি আমরা তাঁর সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তা করি, দিন-রাতের পরিবর্তন, সমুদ্রে জাহাজের ভেসে চলা, মেঘ থেকে পানি পড়ে মৃত জমি প্রাণ ফিরে পাওয়া, বাতাসের চলাচল, মেঘের ভেসে চলা —এই সব নিয়ে চিন্তা করি, তাহলে আমরা যদি বুদ্ধিমান হই, তবে আমরা لَءَايَٰت অর্থাৎ শুধু নিদর্শন নয়, বিরাট সব নিদর্শন খুঁজে পাবো। এই নিদর্শনগুলোও আল্লাহর আয়াত। আল্লাহ আমাদেরকে যেমন কুর’আনের বাণীর মাধ্যমে তাঁর আয়াত দিয়েছেন, একইভাবে তাঁর সৃষ্টিজগতে এই অসাধারণ সব ঘটনার মধ্যেও তাঁর আয়াত দিয়েছেন।

যারা বুদ্ধিমান, তারা সৃষ্টিজগতের এই অসাধারণ সব ঘটনাগুলোর মধ্যে আল্লাহর পরিচয় খুঁজে পাবেন। তাঁর একত্ব, তাঁর মহত্ত্ব উপলব্ধি করে, মুগ্ধ হয়ে তাঁর মহিমার কাছে সমর্পণ করবেন। অনেক বুদ্ধিমান মানুষের জীবনের সবচেয়ে আবেগঘন সিজদাটি হয়েছে, যখন সে সৃষ্টিজগতের মধ্যে আল্লাহর প্রচণ্ড ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, অসম্ভব সুন্দর পরিকল্পনা আবিষ্কার করে শ্রদ্ধায় মাটিতে লুটিয়ে গেছেন। সেই বিরল সিজদার স্বাদ উপলব্ধি করা শুধু সেই সব বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়, যারা আল্লাহর সৃষ্টিজগত নিয়ে গভীরভাবে মুক্তমনে চিন্তা করেন।

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version