কুরআনের কথা

যারা ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাথে আছেন —আল-বাক্বারাহ ১৫৩

আল-বাকারাহ’র এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে জীবনের সকল বিপদ-আপদ, দুঃখ, হতাশাকে হাসিমুখে পার করার জন্য এক বিরাট মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন—

যারা বিশ্বাস করেছ, শোনো: ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করো এবং সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। যারা ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, আল্লাহ تعالى অবশ্যই তাদের সাথে আছেন।  [আল-বাক্বারাহ ১৫৩]

আমাদের জীবনে যখন কোনো বড় বিপদ আসে, কষ্টে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকি, তখন মুরব্বিদেরকে বলতে শোনা যায়, “সবুর করো, সব ঠিক হয়ে যাবে।” দেশে-বিদেশে মুসলিমদেরকে মেরে শেষ করে ফেলা হচ্ছে, কু’রআন পোড়ানো হচ্ছে, রাস্তাঘাটে টুপি-দাড়িওয়ালা কাউকে দেখলে পেটানো হচ্ছে, আর মসজিদের ইমামদেরকে জুম্মার খুতবায় বলতে শোনা যাচ্ছে, “সবর করেন ভাই সাহেবরা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইসলামের বিজয় নিকটেই—ইন শাআ আল্লাহ।”

ব্যাপারটা এমন যে, আমরা ধৈর্য নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে শুধু নামাজ পড়লেই আল্লাহ تعالى আমাদের হয়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিবেন। এই অত্যন্ত প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর মূল কারণ হচ্ছে ‘সবর’ শব্দের অর্থ ঠিকমত না জানা এবং কু’রআনের এই আয়াতে ব্যবহৃত বিশেষ কিছু শব্দের অর্থগুলো ঠিকমত না বোঝা।

এই আয়াতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ রয়েছে: ১) সবর صبر এবং ২) আস্তাই’-নু أستعين । সবর শব্দটির সাধারণত অর্থ করা হয়: ধৈর্য ধারণ করা। কিন্তু সবর অর্থ মোটেও শুধুই ‘ধৈর্য ধারণ করা’ নয় যে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যাব, অবস্থার পরিবর্তনে কিছুই করব না, এই ভেবে যে, একদিন আল্লাহ تعالى সব ঠিক করে দিবেন। প্রাচীন আরবরা যখন ‘সবর’ বলত, তখন এর মধ্যে কোনো দুর্বলতার ইঙ্গিত ছিল না। প্রাচীন আরব কবি হাতিম আত-তাঈ এর একটি কবিতায়[৭] আছে,

তলোয়ার নিয়ে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সবর করলাম, কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেল, স্থির হয়ে গেল।

আরেকটি কবিতা জুহাইর ইবন আবি সুল্মা[৭] এর লেখা—

শক্তিশালী যুদ্ধের ঘোড়ায় চেপে রাজার জামাইরা যুদ্ধের ময়দানে সবর করল, যখন অন্যরা আশা হারিয়ে ফেলেছিল।

উপরের উদাহরণে সবর-এর ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়, সবর মানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। সবর এর অর্থ হচ্ছে: প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য নিয়ে, লক্ষ্য ঠিক রেখে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করা।[৫] সবরের তিনটি অংশ রয়েছে: ১) ধৈর্যের সাথে কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করা, ২) অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ করে না ফেলা, ৩) আল্লাহর تعالى আনুগত্য থেকে সরে না যাওয়া।[৪] মানুষ সাধারণত সবর বলতে প্রথমটিকেই বুঝে থাকে। কিন্তু একজন মুসলিমের জন্য এই তিনটিই বাধ্যতামূলক। এই তিনটির একটি যদি বাদ যায়, তাহলে তা কু’রআন এবং হাদিসের ভাষায় সবর নয়।[৪]

আস্তা’ই-ন এর অর্থ করা হয়: সাহায্য চাও। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে: আপনি একা চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারছেন না, আপনি এখন সহযোগিতা চান। যেমন: রাস্তায় আপনার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি একা ঠেলে পারছেন না। তখন আপনি রাস্তায় কাউকে অনুরোধ করলেন আপনার সাথে ধাক্কা দেবার জন্য। এটা হচ্ছে আস্তা’ই-ন। কিন্তু আপনি যদি আরামে গাড়িতে এসি ছেড়ে বসে থেকে রাস্তায় কাউকে বলতেন ধাক্কা দিতে, তাহলে সেটা আস্তাই’ন হতো না।[১] একারণেই আমরা সূরা ফাতিহাতে বলি: ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাই’ন—আমরা যথাসাধ্য চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাই।

এই দুটি শব্দ যখন একসাথে হয়: আস্তাইনু বিস-সাবরি أ سْتَعِينُوا۟ بِٱلصَّبْرِ তখন এর মানে দাঁড়ায়: যতই কষ্ট, দুর্ভোগ হোক, অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে কোনো পাপ কাজ না করে হালাল উপায়ে চেষ্টা করতে থাকা, নিজের ঈমানকে ঠিক রাখা এবং একই সাথে আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাওয়া।

সালাহ (নামাজ) শব্দটির একটি অর্থ হলো ‘সংযোগ’, আর সালাহ’র বহুবচন হলো সালাত। সালাতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর تعالى সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করি, সবসময় তাঁকে মনে রাখি। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ একারণেই দিয়েছেন, যেন আমরা কাজের চাপে পড়ে, হিন্দি সিরিয়াল আর  খেলা দেখতে গিয়ে বা রাতভর ভিডিও গেম খেলতে গিয়ে তাঁকে ভুলে না যাই। কারণ তাঁকে ভুলে যাওয়াটাই হচ্ছে আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ। যখনি আমরা আল্লাহকে تعالى একটু একটু করে ভুলে যাওয়া শুরু করি, তখনি আমরা আস্তে আস্তে অনুশোচনা অনুভব না করেই খারাপ কাজ করতে শুরু করি। আর এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের পতন।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তার কিছু উদাহরণ দেই—

আপনি অনেক চেষ্টা করেও একটা ব্যবসা ধরতে পারছেন না। মাত্র কয়েক লাখ টাকা ঘুষ দিতে না পারার জন্য কাজটা আপনার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, আপনি ঘুষ দেবেন না, মামা-চাচা ধরবেন না, মন্ত্রীকে একটা ফ্লাট কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তদবির করবেন না।  আপনি ধৈর্য ধরে, কোনো পাপ না করে, নামাজে আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাইবেন এবং একই সাথে চেষ্টা করতে থাকবেন: অন্য কোনো হালাল উপায়ে এগোনো যায় কি না। যদি শেষ পর্যন্ত কোনো হালাল উপায়ে ব্যবসাটা না-ও হয়, ভালো কথা, অন্য কিছুর জন্য চেষ্টা করবেন। আল্লাহর تعالى উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখবেন যে, আপনার ভালোর জন্য আল্লাহ تعالى আপনাকে সেই ব্যবসাটা করতে দিতে চাননি অথবা আপনার ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করা হয়েছে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য।

আপনার বাচ্চার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। আপনি তার মাথায় পানি না ঢেলে, তাকে ডাক্তার না দেখিয়ে, জায়নামাজে বসলেন আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য—এটা এই আয়াতের শিক্ষা নয়। আপনি বাচ্চার চিকিৎসার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন, আর নামাজে বারবার আল্লাহর تعالى কাছে সাহায্য চাইবেন—এটাই এই আয়াতের শিক্ষা। আবার অনেকে বাচ্চার কঠিন অসুখ হলে এবং অনেক চেষ্টার পরও অসুখ ভালো না হলে, আল্লাহর تعالى উপর রাগ করে নামাজ পড়া ছেড়ে দেন, “কেন আমার বাচ্চারই এই কঠিন অসুখটা হবে? আমি কী অন্যায় করেছি? ওই ঘুষখোর চৌধুরী সাহেবের বাচ্চার কিছু হয় না কেন?”—ঠিক এই কাজটা করতেই এই আয়াতে মানা করা আছে।

দেশে ইসলামের দুর্দিন যাচ্ছে, মুসলিমদের ধরে মেরে ফেলা হচ্ছে, মসজিদে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপনার টুপি-দাড়ি বা হিজাব দেখে একদিন আপনাকে রাস্তায় কিছু বখাটে যুবক ধরে মারধোর করল, আর আপনি ঘরে বসে শুধুই আল্লাহর تعالى কাছে কান্নাকাটি করছেন, যেন আল্লাহ تعالى দেশের অবস্থার পরিবর্তন করে দেন, আবার দেশের মুসলিমদেরকে ক্ষমতা দিয়ে দেন, দেশে ইসলামের রাজত্ব কায়েম করে দেন—এটা এই আয়াতের শিক্ষা নয়। এই আয়াতের শিক্ষা হচ্ছে: আপনার প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকলে, আপনি ন্যায় বিচার পাবার জন্য পুলিশের কাছে যাবেন, দরকার হলে সেই যুবকগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করবেন। যতদিন ন্যায় বিচার না পাচ্ছেন: চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করবেন, পত্রিকায় লেখালেখি করবেন এবং একই সাথে প্রতিদিন আল্লাহর تعالى কাছে নামাজে সাহায্য চাইবেন। কিন্তু কখনই প্রতিশোধ নেওয়ার মনোভাব থেকে কু’রআনের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো কাজ করে ফেলবেন না। যেমন, বোমাবাজি, রাস্তায় নিরীহ মানুষের গাড়ি ভাঙা, নিরীহ মানুষের জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করা ইত্যাদি কু’রআনের শিক্ষার বিরোধী কোনো কাজ করবেন না। আল্লাহর تعالى উপর ভরসা রাখবেন যে, তিনি একদিন না একদিন ন্যায় বিচার করবেনই, সেটা এই দুনিয়াতে না হলে, আখিরাতে অবশ্যই হবে।

আয়াতের শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ: يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ — “যারা ঈমান এনেছ, শোনো।” আল্লাহ تعالى এখানে বিশেষভাবে ঈমানের সাথে সবর এবং সালাতকে জুড়ে দিয়েছেন। কারণ যারা ঈমান আনেন, তাদেরকে প্রতিনিয়ত সবরের পরিচয় দিতে হয়। আমরা যারা ইসলাম মেনে চলার চেষ্টা করি, আমাদের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে অনেক সময় আমাদের কাছের মানুষরা আমাদের মনের এমন সব দুর্বল জায়গায় আঘাত করে, এমন সব খারাপ কাজ করে, যার জন্য আমরা ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে মরি। আমরা ইচ্ছা করলেই এমন এক চরম প্রতিশোধ নিতে পারি যে, এর পরে ওরা আর কোনোদিন আমাদের সাথে এরকম করার কথা চিন্তাও করবে না—শুধু দরকার একটুখানি অন্যায় করা, ইসলামের গণ্ডির বাইরে এক পা দেওয়া। কিন্তু আল্লাহর تعالى কথা মনে রেখে আমরা তা করি না। ঈমান নষ্ট করার ঝুঁকি নিই না। রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে অস্থির হয়ে এপাশ-ওপাশ করতে থাকি, মনে মনে রিহার্সাল করতে থাকি: একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কী কী বলা যায়, কী কী করা যায়—কিন্তু পরদিন ঠিকই নিজেকে সংবরণ করি, যেন এমন কোনো কিছু করে না ফেলি, যার জন্য আল্লাহকে تعالى জবাব দিতে পারব না —এটা সবরের লক্ষণ।

আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্য শিখতে পারি: বিপদে পড়লে আল্লাহর تعالى কাছে ধৈর্যের সাথে চেষ্টা এবং নামাজ —এই দুটোর মাধ্যমেই সাহায্য চাইতে হবে। এর একটিও বাদ দিলে হবে না। আর যারা ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, আল্লাহ تعالى তাদের সাথে থাকবেন বলে তিনি কথা দিয়েছেন।

আমরা অনেক সময় জীবনে দুঃখ-কষ্টে পড়লে একাকী অনুভব করি, নিজেকে অসহায় ভাবি। মনে মনে হাহাকার করি, “কেউ কি নেই যার কাছে গিয়ে একটু মনের কষ্টের কথা বলতে পারি, একটু বুকটা হালকা করতে পারি?” —এর উত্তর আল্লাহ تعالى দিয়েছেন:

যারা ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা (সবর) করে, আল্লাহ تعالى অবশ্যই তাদের সাথে আছেন।

আমরা যখন সবর করছি, তিনি আমাদের পাশে আছেন। আমাদের কখনো একাকী অনুভব করার, নিজেকে নিরুপায়, অসহায় মনে করার কোনো কারণ নেই, কারণ আল্লাহ تعالى অবশ্যই আছেন আমাদের পাশে। আমরা যে কোনো সময় নামাজে দাঁড়িয়ে, তাঁর সামনে মাথা নত করে বুকের ভেতর জমে থাকা সব দুঃখ, কষ্ট, অপমান, হতাশা উজাড় করে দিতে পারি। তিনি অবশ্যই তা শুনবেন। তিনি আস-সামি’: সব কিছু শোনেন। আমরাই বরং তাঁর সাথে কথা বলি না।

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version