কুরআনের কথা

তোমরা কী করো, সে ব্যাপারে আল্লাহ বেখেয়াল নন — আল-বাক্বারাহ ১৪০

চৌদ্দশ বছর আগে একদিনের ঘটনা: কয়েকজন উচু পর্যায়ের খ্রিস্টান পাদ্রীরা হন্তদন্ত হয়ে বড় পাদ্রীর সাথে দেখা করতে গেছেন। তিনি এক জরুরি গোপন বৈঠক ডেকেছেন। বাইবেলের কিছু বাণী নিয়ে বিরাট বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। মক্কায় কুরাইশ বংশে এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক নাকি দাবী করছেন: তিনিই হচ্ছেন বাইবেলে ভবিষ্যত বাণী করা শেষ নবী! বাইবেলেই নাকি এক আরব নবীর আগমনের কথা ভবিষ্যত বাণী করা আছে। তারা বাইবেল ঘেটে সেই সব বাণী পড়ে, মক্কার সেই মধ্য বয়স্ক লোকের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছেন, বাইবেলে তার সম্পর্কে যা যা লেখা আছে, তার সব মিলে যায়! হায়, হায়, এখন কী হবে!

তাদের এত বড় চার্চ, এত ক্ষমতা, রাজকীয় সন্মান, বিরাট লোকলস্কর সব শেষ হয়ে যাবে। এতদিন তারা বাইবেল বিকৃত করে, নিজেদের সুবিধা মত বাণী ঢুকিয়ে মানুষকে বোকা বানিয়ে যে আরাম-আয়েসের জীবন পার করছিলেন, তা সব শেষ হয়ে যাবে। সর্বনাশ! যেভাবেই হোক সেই লোকটাকে থামাতেই হবে। বড় পাদ্রী গম্ভীর গলায় বললেন, “যান, ব্যবস্থা করুন। লোকটাকে যেন কালকে থেকে আর খুঁজে পাওয়া না যায়।”

তোমরা কি বলছ যে, ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তার বংশধর গোত্ররা ইহুদি বা খ্রিস্টান ছিল? ওদেরকে বলো, “তোমরা কি বেশি জানো, নাকি আল্লাহ تعالى?” ওর চেয়ে বড় অন্যায়কারী আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ লুকিয়ে রাখে? তোমরা কী করো, সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى কখনই বেখেয়াল নন। [আল-বাক্বারাহ ১৪০]

বিংশ শতাব্দীর ঘটনা: কয়েকজন ‘বিখ্যাত হুজুর’ হন্তদন্ত হয়ে ‘বড় হুজুরের’ সাথে দেখা করতে গেছেন। ‘বড় হুজুর’ এক গোপন বৈঠক ডেকেছেন। বিদেশ থেকে কিছু শেখ এসে কুরআন এবং সহিহ হাদিস ব্যবহার করে তাদের দলের প্রচার করা নানা শিক্ষাকে বিদআত বলে দাবি করছে। উপমহাদেশে শত বছর ধরে চলে আসা তাদের বিখ্যাত দরবার শরিফ, সেই শেখদের প্রচারের কারণে বিতর্কের মুখে পড়েছে। তাদের দরবার শরিফের অনুসারীরা আজকাল নানা ধরনের প্রশ্ন করা শুরু করেছে। টিভিতে নানা ধরনের অনুষ্ঠানে তাদের শত বছর থেকে চলে আসা নানা ইবাদতকে ভুল বলে প্রচারণা করা হচ্ছে। হুজুররা সেই শেখদের সব দাবিকে একেবারে উড়িয়েও দিতে পারছেন না, কারণ সেই শেখদের দলিল বড়ই শক্ত। হায়, হায়, এখন কী  হবে!

এভাবে চলতে থাকলে তো তাদের লক্ষ লক্ষ অনুসারী হারিয়ে যাবে! তাদের দরবার শরিফের মাদ্রাসা, ইসলামিক রিসার্চ কমপ্লেক্স, কোটি কোটি টাকার যাকাত-সাদাকা ফান্ড, আলিশান ভবন, লাইব্রেরি, বিদেশ যাওয়ার ফান্ড  —এগুলো সব তো হুমকির মুখে পড়বে। এতদিন তারা কেউ কেউ নিজেদের মত ফাতওয়া, বিদআহ প্রচলন করে বই বিক্রি করে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে, নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব, ফান্ড কালেকশন, সরকারী পলিসির ব্যবস্থা করে যে বিশাল সম্পত্তি, প্রতিপত্তির আয়োজন করেছেন, সেগুলো তো শেষ হয়ে যাবে। তাদেরকে আবার গরীবি জীবনে ফিরে যেতে হবে!

এরকম কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। ‘বড় হুজুর’ গম্ভীর গলায় বললেন, “এই সব শেখদের দলিলগুলো যেভাবেই হোক ভুল প্রমাণ করে তিন সপ্তাহের মধ্যে বই বেরুন করুন। ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করুন। এদের বিরুদ্ধে পীর, বুজুর্গদের অপমান করার কালিমা লাগিয়ে দিন। মানুষ তখন এদেরকে আর সহ্য করতে পারবে না। এদেরকে দেশ ছাড়া করে ছাড়বে। আর সরকারকে জানিয়ে দিন: এই সব শেখরা আফগানিস্তানে টেরোরিস্টদের মদদ দেয়। তাহলে সরকার আর এদেরকে দেশে ঢুকতে দেবে না।”

“ওর চেয়ে বড় অন্যায়কারী আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ লুকিয়ে রাখে?”

তোমরা কি বেশি জানো?
ইহুদি, খ্রিস্টানরা দুই পক্ষই নিজেদের মতো দাবি করত যে, সব সত্যিকারের নবী এসেছেন তাদের বংশে, সব নবীরা আসলে তাদেরই ধর্ম প্রচার করে গেছেন, বাকি সব নবী ভন্ড। অথচ তারা ভালো করে জানতো: নবী ইব্রাহিম عليه السلام, ইসমাইল عليه السلام, ইসহাক عليه السلام, ইয়াকুব عليه السلام—এরা কেউ ইহুদি বা খ্রিস্টান ছিলেন না, বরং তারা সবাই এক আল্লাহর উপাসনা করতেন। আজকে যে ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার হচ্ছে, সেগুলোর উদ্ভব হয়েছে এই নবীদের মারা যাওয়ার বহু পরে। কিন্তু তারপরেও ইহুদি, খ্রিস্টানরা দাবি করে যাচ্ছে যে, তাদের ধর্মই সঠিক ধর্ম! একারণেই আল্লাহ تعالى তাদেরকে বিদ্রুপ করে জিগ্যেস করতে বলছেন, “তোমরা কি বেশি জানো, নাকি আল্লাহ تعالى ?[৬] [৩]

ওর চেয়ে বড় অন্যায়কারী আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ লুকিয়ে রাখে?

অনেক সময় আমরা ইসলামের উপর বই বা আর্টিকেল পড়ে উপলব্ধি করি যে, আমরা এতদিন যা শিখে এসেছি, তার মধ্যে ভুল রয়েছে। হাজার বছর থেকে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা কিছু রীতিনীতি, ধারণাগুলো আসলে ইসলাম সমর্থন করে না। অনেক সময় দেখা যায়: আমরা যে দলের শিক্ষা এতদিন অনুসরণ করে এসেছি, তার বিরুদ্ধে কুরআন, সাহিহ হাদিসেই যথেষ্ট শক্ত দলিল আছে। তখন আমরা অনেক সময় ভাবা শুরু করি, “এই খবর যদি মানুষকে জানানো হয় তাহলে ফিতনা তৈরী হবে। মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। হুজুরদের প্রতি শ্রদ্ধা উঠে যাবে। এরচেয়ে বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর ত্যাগ করা ভালো। থাক না কিছু কথা গোপন। আল্লাহ تعالى মাফ করবেন।”

না! আল্লাহ تعالى কঠিনভাবে সাবধান করেছেন—

“ওর চেয়ে বড় অন্যায়কারী আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর تعالى কাছ থেকে পাওয়া প্রমাণ লুকিয়ে রাখে?”

তোমরা কী করো, সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى কখনই বেখেয়াল নন

আমরা অনেক সময় টিভিতে কোনো আপত্তিকর কিছু দেখার সময় ভাবি, “থাক, একটু আকটু দেখলে কিছু হবে না। আল্লাহ تعالى অত কিছু ধরেন না।” ব্যাংক থেকে আসা মাসিক স্টেটমেন্ট-এ সুদের পরিমাণ দেখে নিজেকে বোঝাই, “এত অল্প ব্যাপারে আল্লাহ تعالى কিছু মনে করেন না। আমি না নিলে অন্য কেউ তো ঠিকই নিত।” বছরের এক বিশেষ রঙ ছোড়াছুড়ির উৎসবে, বিপরীত লিঙ্গের গায়ে হাত দিয়ে রঙ ঘসাঘসি করে এসে ফেইসবুকে পোস্ট দেই, “আহ হা, তোমরা এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে এমন বাড়াবাড়ি করছ কেন? আল্লাহ تعالى অনেক বড়। তিনি এসব ছোটখাটো ব্যাপারে ধরেন না।” অফিসে কেউ এসে তার ফাইলটা সবার আগে পাস করার জন্য একটা দামী বিদেশী সিগারেট সাধলে, তাতে টান দিয়ে ভাবি, “একটু আধটু টানলে আল্লাহ تعالى ধরেন না। আল্লাহ تعالى অনেক বড়। আমার মত মামুলি বান্দার দিকে নজর রাখার সময় কোথায় তার?”

আল্লাহ تعالى সাবধান করে দিয়েছেন—

তোমরা কী করো, সে ব্যাপারে আল্লাহ تعالى কখনই বেখেয়াল নন।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আরবিতে অত্যন্ত কঠিনভাবে বলেছেন وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ — খবরদার! আল্লাহ تعالى এক মুহুর্তের জন্যও বেখায়াল নন! আমরা টিভিতে আড়চোখে তাকিয়ে কী দেখি, তা আল্লাহ تعالى খুব ভালোভাবে খেয়াল করেন। আমরা বাচ্চাদেরকে স্কুলে দেওয়ার সময় কাকে ফোন করে কী অফার দেই, সেটা আল্লাহ تعالى খুব ভালো করে শোনেন। চাকরির ইন্টারভিউ এর আগে মামা-চাচা-খালুকে কী অনুরোধ করি, সেটা আল্লাহ تعالى রেকর্ড করে রাখেন। বিল দিতে বলার সময় কত টাকা বাড়িয়ে লিখতে বলি, যেন অফিস থেকে বেশি টাকা আদায় করা যায়, সেটার আল্লাহ تعالى হিসেব রাখেন। আল্লাহ تعالى এক মুহুর্তের জন্যও বেখায়াল নন।

আল্লাহ الغفور আল-গাফুউর — অনেক পাপ ক্ষমা করেন, الغفار আল-গাফফার — বার বার ক্ষমা করেন। কিন্তু তাই বলে তিনি غَٰفِل গাফিল — বেখায়াল, অসতর্ক, উদাসীন নন। আমাদের নিয়ত যদি হয় আল্লাহর تعالى ক্ষমার গুণের ফায়দা উঠিয়ে পাপ করে যাওয়া, তাহলে সেটার ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

আল্লাহ تعالى তাওবাহ বা আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করেন, বার বার করেন, যদি সেই ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সেই পাপ আর কখনো না করার প্রতিশ্রুতি থাকে। তাওবাহ এসেছে ت و ب থেকে যার অর্থ: ফিরে আসা। আমরা যদি শুধু মুখে বলি, “আল্লাহ, আমি ভুল করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দিন”—তাহলে সেটা তাওবাহ হলো না। তাওবাহ হচ্ছে: ১) যেই ভুল কাজটা করছিলাম সেটা করা বন্ধ করা, ২) অন্যের সাথে অন্যায় করলে তার প্রায়শ্চিত্ত করা বা তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া, ৩) একই সাথে আল্লাহর تعالى কাছে ভুল করার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং ৪) সেই ভুল ভবিষ্যতে আর না করার জন্য প্রতিজ্ঞা করা।[৫] তাহলেই সেটা তাওবাহ হবে।

আসুন আমরা আন্তরিকভাবে আল্লাহর تعالى কাছে তাওবাহ করি। এতদিন আল্লাহকে تعالى উপেক্ষা করে যে সব খারাপ কাজ করছিলাম, ধরে নিচ্ছিলাম যে, আল্লাহ تعالى অতশত খেয়াল করেন না, সেগুলোর জন্য আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করি। আল্লাহ تعالى কখনই গাফিল নন, কিন্তু তিনি গাফুউর, গাফফার। তাঁর কাছে আকুলভাবে ক্ষমা চেয়ে নিজেকে সংশোধন করলে, তিনি ক্ষমা করে দেবেন বলে কু’রআনে বার বার কথা দিয়েছেন।

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version