কুরআনের কথা

ওদেরকে কোনো দাবি না রেখে ক্ষমা করো — আল-বাক্বারাহ ১০৯-১১০

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাইকোলজি শেখাবেন। মানুষ কিছু মানসিক সমস্যায় ভোগে, যার সম্পর্কে আমাদের সবসময় সাবধান থাকতে হবে। সাবধান না থাকলে, কিছু অসাধু মানুষ সহজেই আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাদের জীবনে নানা সমস্যা সৃষ্টি করবে। আমরা সরল মনে এদের ভালো করতে গিয়ে, এদের সাথে মিলমিশ করে থাকতে গিয়ে উল্টো নিজেদের বিরাট ক্ষতি করে ফেলব। আমরা বুঝতেও পারবো না: কীভাবে আমরা তাদের হাতের পুতুল হয়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে কাজ করে যাচ্ছি। এরকম একটি প্রেক্ষাপট এসেছে এই আয়াতে—

যদিও তাদের কাছে সত্য পরিষ্কার হয়ে গেছে, তারপরেও আহলে কিতাবের (ইহুদি, খ্রিস্টান) অনুসারীদের অনেকেই তাদের স্বার্থপর হিংসার কারণে চায় যে, তোমাদের যাদের ঈমান আছে, তারা যেন আবার কাফির হয়ে যায়। ওদেরকে কোনো দাবি না রেখে ক্ষমা করো, কোনো কিছু ধরে না রেখে উপেক্ষা করো; যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর تعالى নির্দেশ না আসছে। আল্লাহর تعالى সবকিছুর উপরে সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে। [আল-বাক্বরাহ ১০৯]

এই ধরনের ইহুদি খ্রিস্টানরা বেশিরভাগই চায় না যে, ইসলামের প্রচার হোক, মুসলিমদের কোনো উন্নতি হোক। কারণ তারা বুঝে গেছে ইসলাম একটি সত্য ধর্ম, এবং এই ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা কোনো এক অদ্ভুত কারণে ‘আশঙ্কাজনক’ হারে বাড়ছে, যা তারা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি সরূপ মনে করে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার তথাকথিত মুসলিম দেশগুলো থেকে বহুগুণে বেশি। সিএনএন-এর রিপোর্টে[২৩৮] প্রকাশ করা নিচের ম্যাপটি যেকোনো ইহুদি, খ্রিস্টান বা হিন্দুর রাতের ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট—

১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মুসলিমদের বৃদ্ধির হার: ফ্রান্স ৭২৮%, ফিনল্যান্ড ২৮১%, সুইডেন ২০৬%, নরওয়ে ১৮৬%, পোল্যান্ড ২৩৩%, কানাডা ২০০%, চিলি ৩০০%, স্পেইন ২৭৬%, অস্ট্রেলিয়া ১৫৯%, আর্জেন্টিনা ১২৫% ইত্যাদি।[২৩৮] সেই তুলনায় বাংলাদেশ ৪৫.৫%, সৌদি আরব এবং পাকিস্তানে ৫৮%।

এই ধরনের ইহুদি, খ্রিস্টানদের জন্য পাশ্চাত্যের আধুনিক দেশে মুসলিমদের বৃদ্ধির হার একটা ভয়াবহ ঘটনা। সেজন্য তারা প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার বাজেট খরচ করে, বিশাল লোকবল নিয়োগ করে ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক আধুনিক, শক্তিশালী, সম্পদশালী দেশগুলোতে মুসলিমদের বৃদ্ধি কমাতেই হবে। এজন্য তারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার কিছু নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো।

মিডিয়া দখল

আজকে মিডিয়া পুরোপুরি ইহুদিদের দখলে। তারা শুধু যে দখল করেছে তা-ই না, বরং সেটা তারা গর্ব করে ইহুদি পত্রিকাগুলোতে প্রকাশও করে:

“Time-Warner, Disney, Viacom-CBS, News Corporation and Universal rule the entertainment world in a way that the old Hollywood studio chiefs only dreamed of. And, after all the deals and buyouts, four of the five are run by Jews. We’re back to where we started, bigger than ever.” — Jewish Week, 9-17-1999, 12.
টাইম ওয়ার্নার, ডিজনি, ভায়াকম-সিবিএস, নিউজ কর্পোরেশন, এবং ইউনিভার্সাল স্টুডিও আজকে সারা বিনোদন জগতকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, যা হলিউডের পূর্বসূরিরা শুধু কল্পনাই করে গেছেন। … পাঁচটির মধ্যে চারটি স্টুডিও আজকে ইহুদিদের দ্বারা পরিচালিত। আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, আজকে আবার সেখানে পৌঁছে গেছি, বরং আরও বড় আকারে।[২৩৩]

“Let’s be honest with ourselves, here, fellow Jews. We do control the media. We’ve got so many dudes up in the executive offices in all the big movie production companies it’s almost obscene. […] Did you know that all eight major film studios are run by Jews?” — Jewish journalist Elad Nehorai in “Jews DO control the media”, The Times of Israel, July 1, 2012.
ইহুদি ভাইরা, চলেন আমরা একটা ব্যাপারে খোলাখুলি হই: আমরা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করি। এটা চিন্তার বাইরে যে, কত বড় বড় চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সব আমাদের লোক।… তোমরা কি জানো: আজকে সবগুলো বড় ফিল্ম স্টুডিও ইহুদিদের দ্বারা পরিচালিত?[২৩৩]

তারা সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে সুকৌশলে দেখাচ্ছে: যত টেররিস্ট সব হচ্ছে মুসলিম, বিশেষ করে আরব দেশের মুসলিম। জলদস্যু, চোর-ডাকাত, অপহরণকারী, জঙ্গিরা হচ্ছে সব আফ্রিকার কালো মুসলিমরা, না হয় আফগান। বোমাবাজি, আত্মঘাতী বোমা হামলা এগুলো সব হয় পাকিস্তানি, ইরাকি, ইরানি মুসলিমদের দিয়ে। এভাবে তারা সারা পৃথিবীর মুসলিম এবং অমুসলিম দুই দিকেই ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সাধারন মানুষের ভেতরে দিনে দিনে ইসলামের প্রতি একধরনের অন্ধ ঘৃণা তৈরি হচ্ছে।

যার ফলাফল: হলিউডের মুভি দেখে মগজ ধোলাই হওয়া কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা আজকে নিজেদেরকে মুসলিম পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। মাদ্রাসার তরুণ ছাত্রদের দেখলে প্রথমেই ধরে নেয়: সে একজন হবু টেররিস্ট। সুন্নতি টুপি-দাঁড়িওলা কোনো মানুষ তার কাছে একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত, বিজ্ঞান বিবর্জিত, পশ্চাদপদ, সমাজের আবর্জনা মনে হয়। আর অমুসলিমদের অবস্থা আরও করুণ। তারা সারাদিন মুসলিমদের আতংকে থাকে। মনে প্রাণে চায় পৃথিবী থেকে সব আপদ মুসলিমগুলো দূর হয়ে যাক।

বলিউডের আসল চেহারা

হিন্দুরা ইহুদিদের সাথে হাত মিলিয়েছে ইসলামের চরম অপমান করে মুসলিমদেরকে কোণঠাসা করতে। বেশিরভাগ বলিউডের ছবিতে যত খারাপ চরিত্রগুলো হয় মুসলিম। যেমন, ‘গ্যাংস্টার’ ছবিতে দেখান হলো মুসলিম গ্যাং যতসব অসামাজিক কাজ করছে। এই ছবিতেই আমাদেরকে শিয়াদের মত ‘ইয়া আলি’ গান গাওয়া শেখানো হলো, যা একটি পরিষ্কার শিরক। ‘ফানা’ ছবিতে টেররিস্টরা সব হচ্ছে কাশ্মীরি মুসলিম, আর ভারতীয়রা সব সাধু, দেশপ্রেমিক। ‘ভির যারা’, ‘জখম’ ছবিতে ইসলামের শিক্ষা নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করা হলো। এধরনের ছবিগুলোর প্লট ঘুরে ফিরে একটাই: নায়িকা থাকে মুসলিম পরিবারের এবং যত দোষ সেই রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের শিক্ষার এবং সংস্কৃতির, যা আধুনিকতার বিরুদ্ধে যায়, নায়ক-নায়িকার ‘পবিত্র’ প্রেমের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।[২৩৭]

মুসলিমদেরকে দেখান হয় হিন্দু বাড়ির চাকরের ভূমিকায়, না হয় সমাজের নিচু স্তরের মানুষদের ভূমিকায়। ‘মিশন কাশ্মীর’ ছবিতে জিহাদের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে অবজ্ঞা করে তাদের সেক্যুলার চিন্তাভাবনা প্রচার করা হলো। ‘হে রাম’  ছবিতে সুবিধাবাদী মুসলিমদের দেখিয়ে হিন্দুদের জাতীয়তাবোধের জয়গান করা হলো। হলিউডের Bruce Almighty ছবির নকল করে বানানো ‘গড তুসি গ্রেট হো’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনকে ‘আল্লাহ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হলো, এমনকি ‘আল্লাহ’ শব্দটাও ব্যবহার করা হলো। এভাবে হিন্দুরা মুসলিমদেরকে অপমান করে, ইসলামের শিক্ষাকে ঠাট্টা তামাশা হিসেবে উপস্থাপন করে, মুসলিমদেরকে হিন্দুদের থেকে অধম জাতি হিসেবে প্রমাণ করে। আর আমরা মুসলিমরাই হাঁ করে তাদের ছবিগুলো গিলতে থাকি, তাদের শিরকে ভরা ‘ওম শান্তি ওম’, ‘হরে কৃষ্ণা’ গানগুলো গেয়ে যাই।[২৩৭]

এগুলো ঘটনাচক্রে বা কালেভদ্রে ঘটে না। এসবই পূর্বপরিকল্পিত, যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করে করা।

আরব মিডিয়া ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে

আমরা অনেকেই জানি না, বেশ কিছু আরব মিডিয়া আজকে ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে। যখন আল-জাজিরা চ্যানেলটি প্রথম প্রকাশ পায়, মুসলিমরা ভেবেছিল: অবশেষে মুসলিমদের পক্ষে একটা মিডিয়া তৈরি হলো, যা ইহুদিদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে কাজ করবে। কিন্তু এই তথাকথিত  আরব মিডিয়ার ইংরেজি চ্যানেলটির ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায়, সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে ইহুদি রয়েছে, যারা তাদের জ্ঞানগর্ভ রিপোর্টের মাধ্যমে আমাদেরকে শেখাচ্ছেন: কীভাবে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে পর্যালোচনা করতে হবে—

উপরের তালিকাটি আল-জাজিরার একদিনের অনুষ্ঠানগুলোর সময়সূচী। লক্ষ্য করলে দেখবেন: Weisbrot, Chomsky, Sachs, Falk, Miliband, Rogoff, Shabi এরা সবাই ইহুদি। এদের মধ্য অনেকেই ইহুদিদের বিরুদ্ধতা করলেও তাদের ইসরাইলের প্রতি বিশেষ নিরপেক্ষতা লক্ষ্য করার মত।

ইন্টারনেট এর সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে

ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক, প্রধান নির্বাহীরা শুধু ইহুদিই নয়, বরং এরা হচ্ছে জায়োনিস্ট — এরা সব ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোরতর সমর্থক—[২৩৪]

এই সংগঠনগুলো, বিশেষ করে গুগল, প্রত্যক্ষভাবে ইসরাইলের সাথে কাজ করে যাচ্ছে তাদেরকে সামরিক এবং রাজনৈতিক কাজে সাহায্য করার জন্য। উইকিলিক্সের জনক জুলিয়ান আসাঞ্জ প্রকাশ করে দিয়েছেন গুগল কিভাবে আমেরিকা এবং ইসরাইলের সরকারের সাথে গোপনে কাজ করে যাচ্ছে।  গুগলের একজন ডিরেক্টর কোহেন, যিনি ‘ডিরেক্টর অফ আইডিয়া’ পদে আছেন, তিনি আফগানিস্থানে চেষ্টা করছিলেন সবগুলো মোবাইল ফোনের কোম্পানির টাওয়ারগুলোকে সেখানকার আমেরিকার আর্মির ঘাঁটিতে স্থানান্তরিত করতে। তিনি লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে একটি শিয়া সংগঠন তৈরিতে সহায়তা করেন। লন্ডনে তিনি বলিউডের ফিল্মের পরিচালকদের নানা ভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিলেন যেন তাদের ছবিগুলোতে মুসলিমদের উস্কানি দেওয়া চরমপন্থি ব্যাপার কম দেখানো হয়। এই হচ্ছে গুগলের একজন ডিরেক্টরের কাজ! [২৩৫]
গুগল সম্প্রতি ৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে একটি গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করেছে ইসরাইলের রাজধানী তেলআভিভ-এ। এটি বিশ্বের দশম সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর, যেখানে বেতন মাত্রাতিরিক্ত বেশি, গড় আইকিউ লেভেল মাত্র ৯০, যা ‘পতিতাবৃত্তির রাজধানী’ নামে বিশ্বে পরিচিত, যেখানে রাশিয়ান বাচ্চাদের দাস হিসেবে কেনাবেচা হয়। একইসাথে এটি হেরোইন এবং অন্যান্য ড্রাগের বেচাকেনার একটি হাব। এরকম একটি জায়গায় বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে গুগল গবেষণা কেন্দ্র কেন বসিয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আর যাই হোক, এর কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই। [২৩৬]

ইসলামের অপপ্রচারে কোটি কোটি টাকার বাজেট

প্রতি বছর শত শত অমুসলিম সংগঠন কোটি কোটি টাকার বাজেট খরচ করছে ইসলামের বিরুদ্ধে ভুয়া, হিংসাত্মক, অশ্লীল, চমকপ্রদ, অলৌকিক তথ্য দিয়ে ইন্টারনেট ভরে দিতে, যা পড়ে মুসলিম এবং অমুসলিম উভয় মানুষরাই ব্যাপক বিভ্রান্ত হয়ে ইসলামের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই নিচের বিখ্যাত দাতা সংগঠনগুলো ২০০১-২০০৯ সালের মধ্যে ৪২.৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে বই, ওয়েবসাইট, টিভি প্রোগ্রাম, চলচ্চিত্র, ইউটিউব, ফেইসবুক-এর মাধ্যমে আমেরিকায় এবং সারা বিশ্বে মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রতি আতংক ছড়িয়ে দিয়ে, ইসলাম যে একটি মধ্যযুগীয়, বর্বর, ‘টেররিস্ট বানানোর ধর্ম’ —মানুষের মধ্যে এই ভুল ধারণাগুলো বদ্ধমূল করে দেবার জন্য-

Democracy Now -এর নিচের ভিডিও ইন্টার্ভিউটি দেখলে এবং এই রিপোর্টটি http://www.americanprogress.org/issues/religion/report/2011/08/26/10165/fear-inc/ পড়লে বুঝতে পারবেন, কত ব্যাপক ভাবে মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রতি ভীতি প্রচার করার জন্য এবং মুসলিমদেরকে কোণঠাসা করে রাখার জন্য সরকারের উচ্চপদস্থ নেতা থেকে শুরু করে, বিলিয়নীয়াররা পর্যন্ত সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

মনে রাখবেন, ইন্টারনেট হচ্ছে শিক্ষিত এবং অত্যন্ত দক্ষ প্রতারকদের জায়গা। এখানে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, সবচেয়ে মোক্ষম ভাবে মানুষকে প্রতারিত করা হয়, যেটা অনেক শিক্ষিত, আধুনিক মানুষও ধরতে পারেন না। আপনি নিজেকে যতই বুদ্ধিমান, আধুনিক, বিবেচক মানুষ মনে করুন না কেন, বছরে কয়েক কোটি টাকার বেতন দিয়ে পিএইচডি করা স্কলারদের রাখা হয়েছে, যাদের কাজই হচ্ছে ভুয়া ইসলামিক আর্টিকেল লিখে শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মুসলমানদেরকে বোকা বানানো। ইসলামের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য প্রচার করে বিধর্মীদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার জন্য বই লেখা, সারা পৃথিবীতে ইসলামের বিরুদ্ধে লেকচার দিয়ে বেড়ানো এবং বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে মগজ ধোলাই করা, যাতে করে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়। এদের বই, আর্টিকেল, ওয়েবসাইট, লেকচারে মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়ে অনেক শিক্ষিত, ধার্মিক মানুষ ঘোরতর নাস্তিক হয়ে গেছে। সুতরাং সাবধান!

আমরা মুসলিমরা কীভাবে ইসলামের ক্ষতি করি

ইসলামের বিরুদ্ধে এত সব অপপ্রচার, প্রতারণা, বিশাল বাজেট, বিশাল লোকবল, এত রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষমতা, এই সব দেখে স্বাভাবিকভাবেই একজন মুসলিমের রক্ত গরম হয়ে যাওয়ার কথা। বিশেষ করে চোখের সামনে আমাদের মুসলিম ভাইবোনরা এই সব অপপ্রচারের শিকার হয়ে অমুসলিম হয়ে যাচ্ছে, এটা সহ্য করা কঠিন কাজ। এর বিরুদ্ধে কিছু একটা অবশ্যই করা দরকার। প্রথমেই অনেকের মাথায় যা আসে তা হলো: অস্ত্র হাতে নিয়ে জিহাদ শুরু করো, যেখানেই ইহুদি, খ্রিস্টান, মুশরিক পাও — ধরে ধরে মারো, গায়ে বোমা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়; ঘরবাড়ি, যানবাহন ধ্বংস করো ইত্যাদি যত ভাবে পারে তাদের ক্ষতি করো। তারা আমাদের ক্ষতি করছে, আমরাও তাদের ক্ষতি করব, সেটা যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন।

কিন্তু আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কী শিখিয়েছেন?

ওদেরকে কোনো দাবি না রেখে ক্ষমা করো, কোনো কিছু ধরে না রেখে উপেক্ষা করো; যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশ না আসছে।

ইহুদি, খ্রিস্টান, মুশরিকরা চাইবে আমাদের মধ্যে যাদের ঈমান আছে, তারা যেন ঈমান হারিয়ে আবার কাফির হয়ে যাই। এজন্য তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে অনেক কিছুই করছে। কিন্তু এতসব কিছু দেখে ভয় না পেয়ে, আমাদেরকে যা করতে হবে তা হলো— ওদেরকে কোনো দাবি না রেখে ক্ষমা করা এবং উপেক্ষা করা।

আ’ফুউ عفو হচ্ছে কোনো দাবি না রেখে ক্ষমা করা।[১২] ক্ষমা করার পর যদি আমরা ভেতরে ভেতরে গজগজ করতে থাকি, মাঝে মধ্যে আফসোস করি, “ক্ষমা করাটা উচিত হয়নি, এত সহজে ছেড়ে না দিলেও পারতাম” — তাহলে সেটা আর আ’ফুউ হলো না।

ইসফাহু ٱصْفَحُوا۟ এসেছে সাফাহা থেকে যার অর্থ ঘুরে দাঁড়ানো, উপেক্ষা করা। কোনো কিছু ধরে না রেখে উপেক্ষা করে ভুলে যাওয়া হচ্ছে সাফাহা।[১২] আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সাবধান করছেন: আমরা যেন এই সব প্রচারণা দেখে ঘাবড়ে না যাই। দিনরাত অশান্তিতে, দুশ্চিন্তায় না ভুগি। সারাদিন বসে বসে জল্পনা কল্পনা করতে না থাকি। ওরা যত যাই করুক, ইসলাম গত ১৪০০ বছর ধরে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ওদের এত চেষ্টার পরেও, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ এখনও যেই ধর্ম গ্রহণ করছে, সেটা হলো ইসলাম। এত আয়োজনের পরেও ওরা ইসলামের প্রসার আটকাতে পারছে না।

এখন প্রশ্ন আসে: আমরা কী তাহলে ইহুদি, খ্রিস্টানদের ছেড়ে দেব? ওরা আমাদেরকে যা খুশি তাই অপবাদ দিতে থাকবে? তাহলে ইসলামের কী হবে? ইসলাম কী তার গৌরব হারিয়ে ফেলবে না? পৃথিবীর মানুষ কি দিনে দিনে অমুসলিম হয়ে যাবে না? মুসলিমরা কি তাদের শক্তি হারিয়ে আরও পরাজিত হয়ে যাবে না?

আসুন দেখি আমরা যা করি, তাতে কার কী লাভ হয়?

ধরুন, ফেইসবুকে কোনো এক যদুমধু একদিন ইসলামের বদনাম করে আর্টিকেল লেখা এবং শেয়ার করা শুরু করল। একদিকে সারা পৃথিবীর সব ধর্মের শিক্ষিত, বিবেকবান মানুষরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রচার করছে, আর সে খুঁজে খুঁজে ইন্টারনেটের কানা গলি, ঘুপচি থেকে ইসরাইলের সমর্থনে, গাজার বিপক্ষে কিছু আর্টিকেল বের করে শেয়ার করে যাচ্ছে, যেগুলোর খবর কেউ জানে না। কিন্তু আপনি আর সহ্য করতে পারলেন না। সে একটা করে পোস্ট করে, আর আপনি ঝাঁপিয়ে পড়েন তার বিরুদ্ধে কমেন্ট লিখতে। মাঝখান থেকে আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে যারা আছে, যারা হয়ত কোনোদিনও সেই লোকটার ব্যাপারে জানতো না, সেই আর্টিকেলগুলো পড়তো না, তারা আপনার কমেন্টের কারণে সেগুলো পড়ে ফেলল। শুধু তাই না, আপনার কমেন্টে লাইক করে সেগুলো তারা তাদের ফ্রেন্ড লিস্টে প্রচার করে দিল। আপনি সেই যদুমধুকে বিখ্যাত করে দিলেন। মানুষের মাঝে তার প্রচার আরও বাড়িয়ে দিলেন। ঠিক যে জিনিসটাই সে চাচ্ছিল — মানুষের মনোযোগ এবং প্রচার, সেটাই সে আপনার কারণে পেয়ে গেল।

আরেকটি ঘটনা দেখি: মুসলিমদেরকে কাফির বানিয়ে ফেলার ইহুদি-খ্রিস্টানদের এত সব ষড়যন্ত্র দেখে আর থাকতে না পেরে, একদিন জিহাদের আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ কিছু মুসলিম ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন: তারা এম্বেসির সামনে গিয়ে কয়েকটা গাড়ি পোড়াবেন, যাতে ইহুদি, খ্রিস্টানরা বুঝতে পারে মুসলিমরাও বাঘের বাচ্চা। যেই ভাবা সেই কাজ।

পরের দিন খবরের কাগজে তাদের কাজ ফলাও করে প্রচার করা হলো। সেই খবর বিদেশি মিডিয়াগুলো লুফে নিলো। তারা সেটাকে ঢাকঢোল পিটিয়ে এমন ভাবে প্রচার করা শুরু করল যে, মুসলিমরা হচ্ছে যতসব বর্বর, আগ্রাসী, মারামারি, খুনাখুনি টাইপের জাতি। কিছু হলেই তারা জানমালের ক্ষতি করে, মানুষের জীবনের প্রতি হুমকি হয়ে যায়। এভাবে মুসলিমদের টেররিস্ট হিসেবে যে বদনাম ছিল, সেটা আর বেড়ে গেল। সারা বিশ্বের মুসলিমরা তাদের অমুসলিম প্রতিবেশীর কাছে আরও ছোট হয়ে গেলেন। এমনিতেই তারা অনেক অপমান, দুর্ব্যবহার, বৈষম্য সহ্য করে জীবন পার করছিলেন। এই ঘটনার পর সেটা আরও বেড়ে গেল।

সেই উৎসাহী মুসলিম ভাইরা ভেবেছিলেন: তারা কিছু গাড়ি পুড়িয়ে ইহুদিদেরকে এমন শিক্ষা দেবেন, যেন তারা আর কখনও ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু করার আগে দশবার চিন্তা করে। মাঝখান থেকে ইহুদিরাই মুসলিমদের এমন শিক্ষা দিল যে, মুসলিমরা মুসলিমদের প্রতি বিরক্ত হয়ে, নিজেদের ভেতরে বিতৃষ্ণা তৈরি হয়ে গেল। মুসলিমরাই মুসলিমদেরকে ঘৃণা করা শুরু করল। যেটুকু ঐক্য ছিল, সেটাও চলে গেল। মাঝখান থেকে এই পুরো ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো কিছু নিরীহ মুসলিমেরই, যারা অনেক বছর কষ্ট করে টাকা জমিয়ে গাড়ি কিনেছিলেন, যেগুলো সেই উৎসাহী মুসলিম ভাইরা পুড়িয়ে ফেললেন।

গাড়ি পোড়ানোর উদাহরণটা একটি খুবই সাধারণ উদাহরণ। এরকম শত শত উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মুসলিম ভাইয়েরা ছোটখাটো বিধ্বংসী ঘটনা ঘটিয়ে মনে করেন: সরকার পতন হয়ে যাবে, দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, সারা পৃথিবীর ইহুদি, খ্রিস্টানদের আত্মা কেঁপে যাবে, দেশে ইসলামের শাসন কায়েম হয়ে যাবে ইত্যাদি। সে রকম কিছু হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো ইহুদি, খ্রিস্টানরা আরও শক্তি নিয়ে মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উছিলা পেয়ে যায় মাত্র। আগে তারা গোপনে, পরিমিতভাবে চোরা হামলা চালাত। মিডিয়াতে ইসলামের অপপ্রচার করেই ক্ষান্ত থাকত। কিন্তু এখন তারা টেররিস্ট নিধনের নামে প্রকাশ্যে বিশাল সামরিক শক্তি নিয়ে মুসলিম দেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজারে হাজারে নিরীহ মুসলিমদের হত্যা করে। তাদেরকে এত বড় সাহস এবং সুযোগ আমরা মুসলিমরাই করে দিয়েছি।

এত অন্যায় চারিদিকে, তারপরেও আমরা কি কিছুই করব না?

একটা ব্যাপার লক্ষ রাখতে হবে: এই আয়াতের প্রেক্ষাপট হচ্ছে ইহুদি, খ্রিস্টানদের নানা ফন্দি ফিকির করে মুসলিমদের কাফির বানিয়ে ফেলার আয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদেরকে ক্ষমা করা, উপেক্ষা করার নির্দেশ এসেছে। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটের সাথে: মুসলিমদের সাথে অমুসলিমদের যুদ্ধ, মুসলিম দেশের উপর কাফির দেশের হামলা, মুলিমদের উপর সরকারের অত্যাচার, একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের অধীনে থাকার পরেও সেখানকার ইহুদি, খ্রিস্টানদের ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করা — এই সব প্রেক্ষাপটের কোনো সম্পর্ক নেই। সেই সব প্রেক্ষাপটে কী করতে হবে, তার উত্তর আল্লাহ تعالى এই আয়াতেই দিয়ে দিয়েছেন—

যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর تعالى নির্দেশ না আসছে।

কু’রআনে আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা আমাদেরকে সেই সব প্রেক্ষাপটে কী করতে হবে, তা শেখায়। সেই সব প্রেক্ষাপটে কী করতে হবে, সে ব্যাপারে আল্লাহর تعالى নির্দেশ আমাদের কাছে চলে এসেছে। আমরা যদি এই আয়াতের ক্ষমা এবং উপেক্ষার নির্দেশ সব প্রেক্ষাপটে কাজে লাগাতে হবে মনে করে, কাপুরুষের মত চুপ করে থাকি, যেখানে কোনো কাফির সরকার আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে, মুসলিম ভাইবোনদের উপর আক্রমণ করছে, অন্য দেশের ইহুদি, খ্রিস্টানরা এসে দেশের সম্পদ লুটে নিয়ে যাচ্ছে, দেশের মুসলিমদেরকে আক্রমণ করছে, যুদ্ধ ঘোষণা করছে — তাহলে আমরা বিরাট ভুল করব। এটা এই আয়াতের শিক্ষা নয়, ইসলামের শিক্ষাও নয়। সেই সব প্রেক্ষাপটে কী করতে হবে, তা কু’রআনের আগামী সূরাগুলোতে আসবে।

এরপরের আয়াতেই আল্লাহ تعالى আমাদেরকে আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছেন: আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো কী—

নামাজ প্রতিষ্ঠা করো, এবং যাকাত আদায় করো। তোমরা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য যা কিছুই ভালো অগ্রিম করো, তার সবকিছুই তোমরা আল্লাহর কাছে ফেরত পাবে।  তোমরা যা করো, আল্লাহ তা খুব ভালোভাবেই দেখছেন। [আল-বাক্বারাহ ১১০]

ইহুদি, খ্রিস্টানদের এত সব আয়োজন দেখে, জিহাদের নেশায় পাগল হয়ে আমরা যেন ভুলে না যাই যে, আমাদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব দুটো হচ্ছে: নামাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং যাকাত আদায় করা। সারারাত ফেইসবুকে জিহাদ করে আমরা যদি ফজরের নামাজ সময়মত না পড়ি, তাহলে এর চেয়ে বড় বোকামি আর কিছু হতে পারে না। দিনরাত ইহুদি, খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র নিয়ে পড়াশুনা, গবেষণা, লেখালেখি করে যদি ঠিকমত হিসাব করে যাকাত দিতে না পারি, তাহলে আমাদের ইসলামে গোঁড়ায় গলদ রয়েছে। আগে এই দায়িত্বগুলো আমাদেরকে ঠিকভাবে পালন করতে হবে, তারপরে অন্য কিছু।

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আরেকটি ব্যাপার পরিষ্কার করে দিয়েছেন: কেউ যেন মনে না করে যে, শুধু নামাজ পড়লাম, আর যাকাত দিলাম, কিন্তু জিহাদ করলাম না, তাহলে কিছুই লাভ হলো না। না, বরং আল্লাহ تعالى পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছেন—

তোমরা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য যা কিছুই ভালো অগ্রিম করো, তার সবকিছুই তোমরা আল্লাহর কাছে ফেরত পাবে।  তোমরা যা করো, আল্লাহ তা খুব ভালোভাবেই দেখছেন।

নামাজ এবং যাকাতের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করার পর জিহাদের প্রশ্ন আসে। আর যারা জিহাদ করতে পারছেন না, তারা দুঃখ করবেন না। আপনাদের প্রতিটি ভাল কাজের পুরষ্কার আল্লাহর تعالى কাছে রয়েছে।[৪]

সূত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

Exit mobile version