সূরা আল-বাক্বারাহ যারা ধৈর্য নিয়ে পুরোটা একবার পড়েছেন, তারা দেখবেন, এতে কু’রআনের এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে কিছুটা হলেও বলা হয়নি। আপনি যদি আল-বাক্বারাহ পুরোটা একবার ভালো করে বুঝে থাকেন, তাহলে আপনি সহজেই অমুসলিম বা নাস্তিকদের সাথে যুক্তিতর্কে যেতে পারবেন এবং ইসলাম নিয়ে কাফিরদের যে সব বহুল প্রচলিত অভিযোগ, অশ্লীল উদাহরণ, ভুল ধারণা, ইসলামের উপর আক্রমণ —তা অনেকখানি মোকাবিলা করতে পারবেন। একইসাথে মানুষের জীবনে নিত্যদিনের কষ্ট, হতাশা, অবসাদ, অতৃপ্তি ইত্যাদি মানসিক সমস্যার যথাযথ সাইকোলজিক্যাল সমাধানও আপনি সুরা আল-বাক্বারাহ’তেই পেয়ে যাবেন।
এই সূরাটি পুরো কু’রআনের একটি সারাংশের মতো। মু’মিন হতে হলে নিজের মধ্যে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে, কাফির কারা, মুশরিকদের সংজ্ঞা কী (মু’মিন এবং কাফির-এর সংজ্ঞা নিয়ে আমাদের মধ্যে ব্যাপক ভুল ধারণা আছে), আগেকার জাতিগুলো কী ধরনের ভুল করে গেছে, আমাদের কী ধরনের ভুল করা থেকে দূরে থাকতে হবে, যাতে করে আমরা আগেকার জাতিদের মতো শাস্তি না পাই; সালাত, সিয়াম, হাজ্জ, যাকাতের গুরুত্ব, নবীদের عليه السلام ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা; কখন কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করা যাবে, কখন যাবে না—এমন কিছু নেই যা নিয়ে এই সূরায় কিছুটা হলেও বলা হয়নি।
আলিফ – লাম – মীম
কু’রআনের এই আয়াতগুলো নিয়ে অনেক মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মতবাদ হলো—এগুলো কেন আল্লাহ تعالى কু’রআনে দিয়েছেন, সেটা এখনো মানবজাতি সন্দেহাতীতভাবে বের করতে পারেনি। আল্লাহ تعالى এই অদ্ভুত শব্দগুলো দিয়ে যেন আরবদের চ্যালেঞ্জ করছিলেন যে, “দেখো, কু’রআন তোমাদেরই আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে এমন কিছু রয়েছে, যা বের করার মতো যথেষ্ট পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তায় এখনো তোমরা পৌঁছাতে পারোনি। যদি পারো তো বের করো।” এভাবে তিনি আমাদের বুদ্ধিমত্তা এখনো কোথায় আছে, সে ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছেন, যাতে করে আমরা নিজেদের দুর্বলতা উপলব্ধি করে বিনয়ের সাথে কু’রআন পড়ি।
এছাড়াও এই অক্ষরগুলো মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যবহার হয়। যেমন: আমি যদি কথার মাঝখানে হঠাৎ করে বলা শুরু করি, “হ, ত, জ – কালকে থেকে তিন দিন বৃষ্টি হবে”, স্বাভাবিকভাবেই আপনারা অবাক হয়ে মনোযোগ দিয়ে শোনা শুরু করবেন, ‘বলে কী লোকটা!’ ঠিক একইভাবে আগেকার আরবদেরকে যখন নবী عليه السلام সূরা পড়ে শোনাতেন, তখন হঠাৎ এই অদ্ভুত কিছু অক্ষর দিয়ে তিলাওয়াত শুরু করলে আশেপাশের মানুষরা অবাক হয়ে কান খাড়া করে শুনত।
স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই এই অদ্ভুত আয়াতগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য বের করার জন্য অনেক গবেষণা করেছেন। এর মধ্যে একটি বহুল বিতর্কিত আধুনিক মতবাদ হলো: এই আয়াতে যে অক্ষরগুলো রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে অনেকটা কোডের মতো। গুণে দেখলে দেখা যায় যে, এই অক্ষরগুলো পুরো সূরার প্রতিটি আয়াতে যতবার এসেছে, তা একটি বিশেষ গাণিতিক সামঞ্জস্য অনুসরণ করে। গত ১৪০০ বছরে যদি সূরার একটি অক্ষরও এদিক ওদিক হতো, তাহলে এই গাণিতিক সামঞ্জস্য থাকত না। যেমন: সূরা ক্বাফ শুরু হয়েছে ক্বাফ অক্ষরটি দিয়ে। ক্বাফ অক্ষরটি পুরো সূরায় এসেছে ঠিক ৫৭ বার। ঠিক একইভাবে ক্বাফ অক্ষরটি সূরা আশ-শুরার কোড। সেই সূরাতেও সবগুলো আয়াতে ক্বাফ অক্ষরটি এসেছে ঠিক ৫৭ বার।
৫৭ হচ্ছে ১৯ এর গুনিতক, অর্থাৎ ৫৭ = ১৯x৩। ১৯ সংখ্যাটির বৈশিষ্ট্য হলো এটি প্রাইম সংখ্যাগুলোর একটি, যেগুলো গোপন কোড তৈরিতে ব্যবহার হয়। ধারণা করা হয় যে, এভাবে মহান আল্লাহ تعالى এই বিশেষ অক্ষরগুলো দিয়ে সূরার আরবিতে কেউ কোনো বিকৃতি করেছে কি না, তা যাচাই করার জন্য একটি গাণিতিক ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কেউ যদি কখনো এ ধরনের সূরাগুলোর কোনো আয়াতের শব্দগুলো এদিক ওদিক করে, আমরা এই বিশেষ অক্ষরগুলোর গাণিতিক সামঞ্জস্য ব্যবহার করে সাথে সাথেই তা ধরে ফেলতে পারব। পুরো পৃথিবীতে সমস্ত হাফিয মারা গেলেও আমরা এই গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ঠিকই যাচাই করতে পারব যে, কু’রআনের আরবিতে কোনো বিকৃতি হয়েছে কি না।
আধুনিক যুগে একই ধরনের গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় জরুরি গোপন ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করতে, যাতে করে কেউ সেগুলোর পরিবর্তন করতে না পারে। ১৯ ভিত্তিক এই মতবাদটি বিখ্যাত এবং একই সাথে কুখ্যাত ‘কোড-১৯’ মতবাদ নামে পরিচিত, যা নিয়ে গত ত্রিশ বছরে ব্যাপক আলোড়ন হয়েছে। একটি বিশেষ সংগঠন একে ব্যাপক অপব্যবহার করেছে ইসলাম নিয়ে তাদের বিতর্কিত মতবাদ প্রচার করার জন্য। এই মতবাদটি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে এবং এটি এখনো সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। তাই একে এখনো সবাই মেনে নেয়নি। আশা করা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কিছু গবেষণা শেষ হলে, বিশেষ করে কু’রআনের প্রাচীনতম লিপিগুলোতে আলিফ এবং হামযা এর ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারব এই মতবাদটি সত্যি, না মিথ্যা।
আবারও বলছি, আর যা-ই করুন, ইন্টারনেটে সার্চ করে এটা নিয়ে যা পাবেন, সেটাই বিশ্বাস করে সবার সাথে শেয়ার করতে যাবেন না। ফেইসবুকে এটা নিয়ে অনেক উল্টোপাল্টা কথাবার্তা আজকাল মহামারির মতো ছড়াচ্ছে।
ওটা সেই বই যাতে বিন্দুমাত্র সংশয়-সন্দেহ নেই। একটি পথ নির্দেশক (হুদা) আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সচেতনদের (মুত্তাক্বী) জন্য।
লক্ষ্য করুন আল্লাহ “ওটা” বলে সম্বোধন করেছেন; “এটা” বলে নয়। আল্লাহ এখানে আল-লাওহ আল-মাহফুযে সংরক্ষিত সম্পূর্ণ কু’রআনকে সম্বোধন করেছেন। নবী মুহম্মদ(সা) যখন এই আয়াতটি অন্যদেরকে তিলাওয়াত করে শোনাচ্ছিলেন, তখন তিনি যদি বলতেন, “এটা সেই বই”, তবে প্রশ্ন আসত কোন বইটাকে তিনি নির্দেশ করছেন? তাঁর সামনে তো কোনো বই নেই! তাই “ওটা” বলে দূরের কোনো বইকে সম্বোধন করা হয়েছে।[১]
এছাড়াও ভাষাগতভাবে ذَٰلِكَ (ওটা) ব্যবহার করা হয় কোনো কিছুকে সন্মান প্রদর্শন করে নির্দেশ করার জন্য। এরকম আরেকটি উদাহরণ একটু পরেই পাবেন।[১]
কু’রআনে الْكِتَابُ আল-কিতাব বলতে সবসময় আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক সমস্ত বাণীর সম্পূর্ণ সংগ্রহকে নির্দেশ করা হয়েছে, যা তাওরাত, ইঞ্জিল, কু’রআনসহ অন্যান্য সংকলনের মাধ্যমে মানুষের কাছে ধাপে ধাপে অবতীর্ণ হয়েছে। দেখুন ৫:৪৮, ৯৮:৪, ২:৪৪ ইত্যাদি যেখানে বলা হয়েছে যে, আল-কিতাবের কিছু অংশ আগেও অবতীর্ণ হয়েছিল, যেমন: তাওরাত, ইঞ্জিল এবং অন্যান্য আসমানি কিতাবের মাধ্যমে।[১]
মুসলিমদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, ইসলাম একটি নতুন ধর্ম, যা মুহাম্মাদ عليه السلام প্রথম প্রচার করে গেছেন। এটি একটি ভুল ধারণা। ইসলাম হচ্ছে মহান আল্লাহর تعالى নির্ধারিত সকল মানবজাতির জন্য একমাত্র ধর্ম, যার পুরো বাণী এবং আইন, মহান আল্লাহর تعالى কাছে আল-লাওহ আল-মাহফুযে সংরক্ষিত। সেই আইন এবং বাণীর সম্পূর্ণ সংগ্রহকে কু’রআনে আল-কিতাব বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এই আল-কিতাব থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন প্রজন্মের কাছে, বিভিন্ন রাসূলের মাধ্যমে, প্রয়োজন অনুসারে যেটুকু দরকার, সেটুকু নাজিল হয়েছে। কু’রআন হচ্ছে সেই আল-কিতাবের সর্বশেষ/চূড়ান্ত সংস্করণ বা সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ, যা নবী মুহাম্মাদ عليه السلام-এর মাধ্যমে আমরা একটি বই আকারে পেয়েছি।[১]
এছাড়াও আরেকটি প্রচলিত ভুল ধারণা হলো: যারা মুহাম্মাদ عليه السلام এর অনুসারী শুধুমাত্র তারাই মুসলমান। নবী ইব্রাহিম عليه السلام কা’বা বানানো শেষ করার পরে আল্লাহর تعالى কাছে দু’আ করেছিলেন, যেন তার সন্তান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা মুসলিম হয়।[২:১২৭] নবী ইয়াকুব عليه السلام মৃত্যুর সময় তাঁর সন্তানদেরকে বলে গিয়েছিলেন: তারা যেন কেউ অমুসলিম অবস্থায় মৃত্যু বরণ না করে। ‘মুসলিম’ কোনো বিশেষ উপাধি নয়। যারাই মহান আল্লাহকে تعالى স্রষ্টা মেনে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে, তাঁর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়, তারাই মুসলিম।
لَا رَيْب—লা রাইবা—বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই। প্রচলিত আরবিতে এটা হওয়া উচিত ছিল ‘লা রাইবু’, যেটার অর্থ হতো—কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মহান আল্লাহ تعالى এখানে বিশেষভাবে বলেছেন ‘লা রাইবা।’ শেষের ‘আ’ এর কারণে এর অর্থ হবে—এতে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই![৩]
কু’রআন কোনো মেটাফিজিক্স বা ফিলসফির উপর বই নয় যে, এখানে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মানুষের অনুমান এবং যুক্তির উপর নির্ভর করে থিওরির পর থিওরি লেখা আছে এবং যার ভূমিকাতে লেখক আগেভাগেই বলে দেন, “আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।” কু’রআন এমন একটি বই, যার লেখক এই পৃথিবীর কেউ নন। তিনি মহাবিশ্বের সকল জ্ঞানের অধিকারী, মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। তাঁর কথা কোনো থিওরি নয়, কোনো অনুমান নয়। তাঁর কথা হচ্ছে অকাট্য সত্য। তাঁর বাণীর ৭০-৮০% অংশ আধুনিক বিজ্ঞান সত্যি প্রমাণ করেছে। বাকি ২০-৩০% নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। কিন্তু কু’রআনে এমন কোনো বাণী নেই যেটা আধুনিক বিজ্ঞান সর্বসম্মতিক্রমে প্রমাণ করেছে যে, তা ভুল এবং তার স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দেখাতে পেরেছে।
আধুনিক মানুষদের অনেকেরই ধর্মের অনেক কিছুই মানতে কষ্ট হয়। তারা সবকিছুতেই বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খোঁজেন। যেটাই তাদের কাছে আজকের যুগের বিজ্ঞান অনুসারে ‘অবৈজ্ঞানিক’ মনে হয়, সেটাই তাদের মেনে নিতে কষ্ট হয় এবং সারা জীবন মনের মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধে থাকে। সেক্ষেত্রে তারা প্রোবাবিলিটি ব্যবহার করে দেখতে পারেন। যদি কোনো কিছুর ৭০-৮০% সম্পূর্ণ ১০০ ভাগ সত্য হয়, বাকি ২০-৩০% মিথ্যা না হয়, তাহলে সেই ২০-৩০% সত্য হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সুতরাং কু’রআনের ১০০% সত্য হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই ফরমুলা কাজে লাগালে আশা করি কু’রআনের যে সব ব্যাপার বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাবে মেনে নিতে পারছেন না, সেগুলোতে বিশ্বাস করতে সমস্যা হবে না।
مُتَّقِينَ মুত্তাক্বিন শব্দটির অর্থ সাধারণত করা হয়—যারা খোদা ভীরু। যাদের তাক্বওয়া আছে, তাদেরকে মুত্তাক্বী বলা হয় এবং তাক্বওয়াকে সাধারণত ‘খোদা ভীতি’ অনুবাদ করা হয়। এটি পুরোপুরি সঠিক অনুবাদ নয়, কারণ ‘ভয়’ এর জন্য আরবিতে ভিন্ন শব্দ রয়েছে—যেমন খাওফ خوف, খাশিয়া خشي, হিধর حذر; শুধু কু’রআনেই ১২টি আলাদা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন গভীরতার ভয়, সতর্কতা, আতঙ্ক ইত্যাদি তুলে ধরার জন্য। এর মধ্যে ‘তাক্বওয়া’ হচ্ছে ‘সবসময় পূর্ণ সচেতন’ থাকা।[১][২]
আপনি পরীক্ষা দিতে বসেছেন, কিন্তু প্রশ্নপত্র দেখে আপনার মাথায় হাত। একটা প্রশ্নও কমন পড়েনি! তখন আপনি এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিদর্শকরা কোথায় আছে ভালোভাবে দেখে নিয়ে, পাশের জনের খাতা দেখে কপি করা শুরু করলেন। প্রতি মুহূর্তে আপনি টানটান উত্তেজনার মধ্যে সবসময় সচেতন থাকছেন পরিদর্শকদের কেউ আপনাকে দেখে ফেলল কি না। আপনার এই যে চরম সচেতনতা পরিদর্শকদের ব্যাপারে, সেটা হলো তাক্বওয়া। আপনি এই মুহূর্তে পরিদর্শকদের প্রতি তাক্বওয়া অনুভব করছেন। একইভাবে মুত্তাক্বীরা সবসময় সচেতন থাকে যে, মহান আল্লাহ تعالى তাদেরকে দেখছেন, তাদের প্রত্যেকটা চিন্তা শুনতে পাচ্ছেন, তাদের প্রত্যেকটা কামানুভূতি জানতে পারছেন। মহান আল্লাহর تعالى প্রতি সবসময় এই পূর্ণ সচেতনতাকে তাক্বওয়া বলা হয়।
ধরুন, আপনি প্রতিদিন কী করেন, সেটা নিয়ে একটা ‘রিয়েলিটি টিভি শো’ বানানো হচ্ছে। আপনার বাসার সবগুলো রুমে ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আপনি ঘুম থেকে ওঠার পর ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সবসময় আপনার সাথে একজন ক্যামেরাম্যান আপনার দিকে ক্যামেরা তাক করে রেখেছে। আপনি কী বলছেন, কী করছেন, কী খাচ্ছেন, কী দেখছেন, সবকিছু প্রতি মুহূর্তে রেকর্ড করা হচ্ছে। কল্পনা করুন, যদি এরকম কোনো ঘটনা ঘটে তাহলে আপনার মানসিক অবস্থা কী হবে? আপনি প্রতিটা কথা বলার আগে চিন্তা করবেন যে, আপনার কথাগুলো মার্জিত হচ্ছে কি না, আপনার হাঁটার ধরন ঠিক আছে কি না, আপনি উল্টোপাল্টা দিকে তাকালে সেটা আবার রেকর্ড হয়ে গেলো কি না। আপনি টিভিতে যেসব হিন্দি সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, মুভি দেখেন, যেসব গান শুনেন, ইন্টারনেটে যে সব সাইট ঘুরে বেড়ান, সেগুলো ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে গেলে লোকজনের কাছে মান-সন্মান থাকবে কি না। এই যে ক্যামেরাম্যানের প্রতি আপনার চরম সচেতনতা, এটাই তাক্বওয়া। আল্লাহর تعالى প্রতি আপনার ঠিক একই ধরনের সচেতনতা থাকার কথা।
আপনার দিকে একজন ক্যামেরাম্যান নয়, বরং কমপক্ষে দুই জন অদৃশ্য সত্তা প্রতিমুহূর্তে এমন এক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপনার প্রতিটা চিন্তা, কথা, কাজ রেকর্ড করছেন, যার ধারে কাছে কিছু মানুষ কোনোদিন বানাতে পারবে না। আর সেটা যদি আপনার সাবধান হওয়ার জন্য যথেষ্ট না হয়, তাহলে মনে রাখুন, এমন একজন প্রচণ্ড ক্ষমতাধর সত্তা সবসময় আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন, যিনি সেই অদৃশ্য সত্তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তাদেরকে সেই অভাবনীয় প্রযুক্তি দিয়েছেন। এই মহা ক্ষমতাশালী সত্তা মানুষের থেকেও অনেক অনেক বেশি ক্ষমতাধর বুদ্ধিমান সত্তাদের সৃষ্টি করেছেন, যারা আলোর গতিবেগ অতিক্রম করে এক মুহূর্তের মধ্যে মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গায় চলে যেতে পারে। এই পুরো মহাবিশ্ব তাঁর হাতের মুঠোয়। আপনি তাঁকে কোনোভাবেই এক মুহূর্তের জন্যও ফাঁকি দিতে পারবেন না।
এই আয়াতটির অর্থে একটি লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার রয়েছে: কু’রআন সবার জন্য পথপ্রদর্শক নয়। এটি পথপ্রদর্শক শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা সৃষ্টিকর্তার প্রতি অত্যন্ত সচেতন। এর মানে কী? সবাই কি তাহলে কু’রআন পড়ে সঠিক পথ পাবে না? তাহলে কু’রআন পাঠিয়ে কী লাভ হলো?
পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ অমুসলিম আছে, যারা কু’রআন পড়ে, এমনকি লক্ষ লক্ষ মুসলিম নামধারী মানুষ আছে, এরাও কু’রআন পড়ে। কিন্তু কু’রআন পড়েও তারা নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারেনি। তারা আগেও যেরকম ছিল, এখনো সেরকমই রয়ে গেছে। তারা আগেও ঘুষ খেত, এখনো খায়। তারা আগেও তারকা শো দেখতো, এখনো দেখে। তারা আগেও অর্ধেক শরীর বের করে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করত, এখনো করে। এর কারণ কী?
এর কারণ: তাদের তাক্বওয়ার অভাব। কু’রআন পড়ে তা থেকে শিক্ষা পেয়ে জীবনে পরিবর্তন আনতে হলে, প্রথমে আপনার ভেতরে সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর সচেতনতা তৈরি করতে হবে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করতে হবে।[৩] আপনাকে মানতে হবে যে, আপনি একজন মহান প্রভুর মামুলি দাস মাত্র। তিনি আপনাকে প্রতি মুহূর্তে দেখছেন, আপনার প্রত্যেকটা কথা, কাজ, চিন্তা রেকর্ড করছেন। সঠিক পথ পাওয়ার জন্য তিনি আপনাকে অসাধারণ এক ম্যানুয়াল দিয়েছেন। পৃথিবীতে আরও ৬০০ কোটি মানুষ আছে যাদেরকে তিনি এত বড় সুযোগটি দেননি।
আপনি যখন এই অনুভূতি, এই তাক্বওয়া নিয়ে কু’রআন পড়বেন, শুধুমাত্র তখনই আপনি কু’রআন পড়ে নিজের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবেন। কু’রআন তখন আপনার জন্য হুদান (একটি পথপ্রদর্শক) হিসেবে কাজ করবে।[১] আপনার ভেতরে যদি সেই তাক্বওয়া না থাকে, তাহলে আপনি কু’রআন পড়বেন, তারপর কু’রআনে ‘ভুল’ বের করা শুরু করবেন, কু’রআনের বিরুদ্ধে আর্টিকেল লেখা শুরু করবেন। যেখানেই কোনো ধার্মিক মানুষ পাবেন, তাকে অপদস্থ করার জন্য কু’রআন থেকে মুখস্ত করা কোনো ‘কঠিন’ আয়াত, কোনো ‘বিতর্কিত’ ব্যাপার নিয়ে (যেটা আপনি সবসময় মুখস্ত করে রাখেন) হঠাৎ করে প্রশ্ন করে, তাকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলার চেষ্টা করবেন। কোনো মুসলিম দলের বা ব্যক্তির দোষ ধরে কেউ কোনো আর্টিকেল লিখলে, সেটা ঠিকমতো যাচাই না করেই, নির্লজ্জের মতো ফেইসবুকে শেয়ার করবেন। কু’রআন পড়ে আপনার ভেতরে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না। কু’রআন আপনার জন্য هُدًى (পথপ্রদর্শক) হবে না, বরং অমূলক দার্শনিক যুক্তিতর্ক করে বিকৃত আনন্দ পাওয়ার একটি উৎস হয়ে যাবে।
কু’রআন পড়ে তা থেকে কোনো ধরনের উপকার পাওয়ার প্রথম শর্ত তাক্বওয়া। সেই তাক্বওয়া যাদের মধ্যে আছে, তাদেরকে বলা হয় মুত্তাক্বী। এর পরের আয়াতগুলোতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে মুত্তাক্বী হওয়ার শর্তগুলো বলেছেন।
সুত্র:
- [১] নওমান আলি খানের সূরা আল-বাকারাহ এর উপর লেকচার।
- [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ।
- [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি।
- [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
- [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran
- [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran
- [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি।
- [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী।
- [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ।