শপথ তাদের যারা নির্মমভাবে ছিনিয়ে নেয়, যারা আলতোভাবে বাঁধন ছেড়ে দেয়, যারা তীব্র গতিতে ছুটে চলে, যারা সবার সামনে চলে গিয়ে ফয়সালা করে ফেলে।
আরবরা কান খাড়া করে এক রোমহর্ষক ঘটনা শুনছে। তারা কল্পনা করছে: একদল যুদ্ধের ঘোড়া ছুটে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে মাটিতে পা ঠুকছে। তাদের বাঁধন ছেড়ে দেয়া হল, আর অমনি তারা তীব্র বেগে ছুটে যাওয়া শুরু করল। ছুটতে ছুটতে সবাইকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। শত্রুপক্ষকে শেষ করে যুদ্ধের ফয়সালা করে ফেলতে যাচ্ছে। তারপর…
সেদিন এক ভীষণ কম্পন প্রকম্পিত করবে। তারপর আসবে আরেকটা। অনেক অন্তর সেদিন ভয়ে কাঁপতে থাকবে। তাদের দৃষ্টি হবে ভয়ে নত।
মানে? কোথা থেকে কী আসলো? সেই ঘোড়ার উপর সওয়ারী যোদ্ধাদের কী হলো? কে জিতলো শেষ পর্যন্ত?
সূরা আদিয়াত এর মত সূরা নাযিয়াত-এও আল্লাহ تعالى শুরু করেছেন এক রোমহর্ষক ঘটনা দিয়ে। একপাল ঘোড়ার উপর সওয়ারী যোদ্ধাদের আক্রমণের ধারা বর্ণনা চলছে। টানটান উত্তেজনা চলছে। সবাই কান খাড়া করে শুনছে ঘটনা কী ঘটতে যাচ্ছে। তখন আল্লাহ تعالى হঠাৎ করে বিষয় ঘুরিয়ে দিলেন। কুর‘আনে এরকম কয়েকটা সূরাহ’তে আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ تعالى শুরু করেন একটি ঘটনা দিয়ে। যখন শ্রোতার মনোযোগ পাওয়া যায়, তখন হঠাৎ করে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে নীতি কথাগুলো বলা হয়। যেই কথাগুলো প্রথমে বলে শুরু করলে পাত্তা পাওয়া কঠিন হতো।
মনোযোগহীনতায় ভোগা একটি প্রজন্মকে কিছু শেখানোর জন্য এটা একটি মোক্ষম পদ্ধতি। অনেকটা আজকের দিনে মনোযোগহীন, অস্থির প্রকৃতির কিশোর-তরুণদেরকে কোনো ভিডিও গেমের রোমহর্ষক ঘটনা বলতে বলতে হঠাৎ করে থেমে বলা, “একদিন তোমরা আফসোস করবে কেন বাবা-মার কথা শোনোনি।” —প্রথমে এই ধরনের নীতিবাক্য দিয়ে শুরু করলে তারা বিরস মুখে হাই তুলে মোবাইল টেপাটেপি করতে থাকতো। শুনলেও তা এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যেত। কিন্তু ভিডিও গেমের গল্প দিয়ে শুরু করার কারনে তাদের মনোযোগ পাওয়া গেছে। তখন কোনো ভালো কথা বললে আর খেয়াল না করে থাকতে পারবে না।
আমাদেরকে বুঝতে হবে সবার বোঝার এবং মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা এক নয়। কিছু মানুষ আছে যারা এটা পড়লেই যথেষ্ট—
“যখন তাকে বলা হয়, ‘আল্লাহর ব্যাপারে সাবধান!’ —তখন বরং তার ঔদ্ধত্য তাকে পাপের ধারাবাহিকতায় ডুবিয়ে দেয়।”—আল-বাক্বারাহ ২০৬
—এই কথা পড়ে কিছু মানুষ গভীর চিন্তায় পড়ে যাবে। দিন-রাত তাদের কানে এই কথাগুলো বাজতে থাকবে। তারা যেন এই কথাগুলোর মধ্যে নিজেদেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবে। একসময় তাদের চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা, কাজকর্মে পরিবর্তন আসতে থাকবে।
আবার কিছু মানুষ আছে, যারা একই কথাগুলো বিরস মুখে পড়ে, হাই তুলে পাশ কাটিয়ে যাবে। এত দামি কথাগুলো তাদের উপর কোনোই প্রভাব ফেলবে না। তাদের জন্য লাগবে কিছুটা ভাব-সম্প্রসারণ, সাথে অল্প কিছু বিনোদন। যেমন—
আগামী নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী আলহাজ্ব চৌধুরী সাহেব মসজিদে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচনে দেওয়া কিছু প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তিনি কথা বলবেন, “ভাই সব, আমি আপনাদের এলাকারই সন্তান। এই এলাকার আলো, মাটি, বাতাস খেয়ে আমি বড় হয়েছি। আমি এই বছর হজ্জে গিয়ে আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করেছি, আমাকে তিনি যেন এলাকার খেদমত করার তওফিক দেন। আমি আল্লাহর تعالى শপথ করে বলছি, আমাদের এই এলাকা দুই বছরের মধ্যে হয়ে যাবে পবিত্র মদিনা শহরের এক প্রতিচ্ছবি।” —বিপুল করতালি এবং ‘আল্লাহু আকবার’ এর মধ্য দিয়ে তার ভাষণ শেষ হয়।
নির্বাচন শেষ। চৌধুরী সাহেব জয়ী হয়েছেন। তার আলিশান ড্রয়িং রুমে তিনি তার ‘সোনার ছেলেদের’কে রাতের পার্টির আয়োজনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন, “রাতে ফাইভ স্টার হোটেলের সব ব্যবস্থা ঠিক আছে? মন্ত্রী সাহেব আসবেন ঠিক আটটায়। কাস্টমস থেকে রঙিন পানি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিস তো? স্যার কিন্তু বিদেশি ব্র্যান্ড ছাড়া কিছু পান করেন না। আর এলাকার ডেভেলপারদেরকে আগামীকাল ডাক। এলাকায় যত কাজ হচ্ছে, তার সবগুলোর তালিকা চাই। কে আমাকে কত দিবে, তার উপর নির্ভর করবে, কে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। আর আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর ড্রাইভারটা গত কালকে আমাকে দেখে সালাম দেয়নি। ওর একটা পা ভেঙ্গে দিয়ে আয়।”
—কিছু মানুষ আছেন যাদেরকে এধরনের বিস্তারিত উদাহরণ দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে তারা অনেক সময় উপলব্ধি করতে পারেন না আসলে কী বলা হয়েছে। সমস্যা নেই, সবার চিন্তার গভীরতা এক নয় এবং এক হওয়ার কথাও নয়। আল্লাহ تعالى সবাইকে গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়ে পাঠাননি। আমাদেরকে এই বাস্তবতা বুঝে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
সুরাহ নাযিয়াতের এই আয়াতগুলো আমাদেরকে শেখায় যে, পাঠক/শ্রোতামণ্ডলীর মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা, কীসে তাদের আগ্রহ, তারা কী ধরনের আলোচনা শুনতে অভ্যস্ত —এসব বুঝে তারপর তাদেরকে জ্ঞান দিতে হবে। অনেকে মনে করেন— সংক্ষিপ্তভাবে মূল বিষয়বস্তুতে অটল থেকে ভারি কিছু বাণী ছুঁড়ে দিলেই হবে। যাদের বোঝার তারা ঠিকই বুঝবে। যাদের চিন্তার গভীরতা নেই, সেই সব ‘সস্তা’ মানুষদের কারণে জ্ঞানকে এত সস্তা, হালকা করে ফেললে হবে না। ধর্মের জ্ঞান হতে হবে ভারি মেজাজের, দামি কথা, উচ্চ পর্যায়ের ভাবের ব্যবহার ইত্যাদি। —যারা এরকম গণ্ডির মধ্যে চিন্তা করেন, তাদের জন্য এই ধরনের সুরাহগুলোতে উপলব্ধির ব্যাপার রয়েছে।
সুরাহ নাযিয়াতের এই আয়াতগুলো বিরাট ধাঁধা। এখানে আল্লাহ تعالى আসলেই কীসের কথা বলেছেন, তা নিয়ে কমপক্ষে পাঁচটি মত রয়েছে। এর মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মত হলো, এখানে আল্লাহ تعالى বিশেষ কিছু ফেরেশতাদের কথা বলেছেন। যেমন, কিছু ফেরেশতা আছে যারা অবিশ্বাসীদের জান কবয করার সময় নির্মমভাবে টেনে বের করে। আবার কিছু ফেরেশতা আছে, যারা পুণ্যবান বান্দাদের জান কবয করার সময় আলতোভাবে ছেড়ে দেয়।[১৭][১৮][৮][১৪] —এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মত হলেও এর কিছু সমস্যা রয়েছে।
প্রথমত, কুরআনে কোথাও আল্লাহ تعالى ফেরেশতাদের বেলায় স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যবহার করেননি। বরং ফেরেশতাদেরকে স্ত্রী প্রজাতি না বলার ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি দেওয়া আছে। অথচ এই সূরাহতে নাযিয়াত, নাশিতাত ইত্যাদি এই শব্দগুলো হচ্ছে স্ত্রীবাচক শব্দ। সুতরাং এই শব্দগুলো ফেরেশতাদের উল্লেখ করে বলা হতে পারে না। আল্লাহ تعالى ইচ্ছে করলেই পুরুষবাচক শব্দ ব্যবহার করেও একইরকম ছন্দ মিলিয়ে আয়াতগুলো দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা না করে স্ত্রীবাচক শব্দই ব্যবহার করেছেন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এখানে তাঁর বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মক্কার আরবরা যখন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে নাযিল হওয়া এই আয়াতগুলো শুনছিল, তখন তাদের মনে ফেরেশতা, আত্মা বা মৃত্যুর সময় পাপের শাস্তি পাওয়া —এইসব ধারণা আসার প্রশ্নই উঠে না, কারণ তারা এগুলোতে বিশ্বাসই করত না। এগুলো শোনার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহও ছিল না। তাদের কাছে আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল মারামারি, যুদ্ধ, ঘোড়া ইত্যাদি। আমাদেরকে দেখতে হবে যে, এই আয়াতগুলো যখন রাসুল عليه السلام মক্কার আরবদের শোনাচ্ছিলেন, তখন তাদের মনে কী কল্পনা চলছিল? সেটাই হবে এই আয়াতগুলোর সঠিক অর্থ। —এই মতটি কয়েকটি তাফসিরে পাওয়া যায় এবং আমার কাছে এটাই সঠিক মত মনে হয়েছে।[১৪][১৯][২০]
—এর আরও সমর্থন পাওয়া যায় পরের আয়াতগুলোতেই। যারা এই আয়াতগুলো শুনছিল, তাদের চিন্তা-ভাবনা কী ধরনের তা পরের আয়াতগুলোতে এসেছে—
তারা বলে, “আমরা কি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবো? হাড্ডিগুলো পচে ক্ষয় হয়ে যাওয়ার পরেও?” তারা বলেছিল, “তাহলে তো সেটা বড়ই ক্ষতিকর ফিরে যাওয়া হবে।” —সে তো শুধু একটা বিকট আওয়াজ হবে। অমনি তারা এক খোলা ভূমিতে দাঁড়িয়ে যাবে।
মানুষের হাড়গোড় সব পচে-গলে বা ধুলো হয়ে যাওয়ার পর কীভাবে আবার তাকে পুনরায় তৈরি করা হবে? —এই প্রশ্ন হাজার বছরের। তারা মনে করে যে, মানুষের অস্তিত্ব শুধুমাত্র তার দেহের মধ্যেই সীমিত। দেহ ধ্বংস হয়ে গেলে আর কোনোভাবেই একটি মানুষকে পুনরায় তৈরি করা সম্ভব নয়। মানুষের দেহের কাঁচামাল ব্যবহার করে হয়ত আরেকটি ভিন্ন কোনো মানুষ তৈরি করা যাবে। কিন্তু কখনোই একজন মানুষকে হুবহু একইভাবে আবার তৈরি করা যাবে না। অর্থাৎ মানুষের পুনরুত্থান হওয়া সম্ভব নয়।
তাদের এই ধারনার ভিত্তি হচ্ছে: একজন মানুষের সারা জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, চেতনা —এই সব কিছুই আছে তার মস্তিষ্কে। তাই মস্তিষ্ক ধ্বংস হয়ে গেলে, কোনোভাবেই আরেকটি মস্তিষ্কে হুবহু একই অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব এবং চেতনা তৈরি করা সম্ভব নয়। —মানুষের এই ধারনার ভিত্তি হলো, মানুষ মনে করে যে, মহাবিশ্বে বস্তু এবং শক্তি ছাড়া আর মৌলিক কিছুই নেই। সবকিছুই সৃষ্টি হয় বস্তু এবং শক্তির মাধ্যমে। সৃষ্টিজগত চার মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ — দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, সময়।
আজকাল অনেক বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন যে, মহাবিশ্ব আসলে একটি উচ্চতর জগতের প্রতিচ্ছবি মাত্র। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি কণিকা আসলে উচ্চতর জগতে থাকা কোনো অস্তিত্বের চতুর্মাত্রিক (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, সময়) প্রতিচ্ছবি মাত্র, একটি হলোগ্রাম। দেখুন— Holographic Principle, M-Theory, String Theory। এই সব তত্ত্ব অনুসারে—যার কিছু পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে—আমরা আসলে দেওয়ালে পড়া ছায়া মাত্র। আমাদের ‘আসল অস্তিত্ব’ আছে একটি ঘরের মধ্যে। সেই ঘর আছে উচ্চতর মাত্রায়। সেই ঘরের দেওয়ালে পড়া চতুর্মাত্রিক ছায়া হচ্ছে এই মহাবিশ্ব। আমরা যা কিছুই দেখতে, শুনতে, উপলব্ধি করতে পাই, বিজ্ঞান যা কিছুই পর্যবেক্ষণ করতে পারে, তার সব কিছুই দেওয়ালে পড়া ছায়া।
মৃত দেহ পচে গলে হারিয়ে যাওয়ার পর আবার কীভাবে জীবিত হবে, তা বোঝার জন্য আমরা আবারো উচ্চতর জগতের ছায়ার উপমা দিতে পারি। যখন এই মহাবিশ্বে আমার দেহ গুড়া গুড়া হয়ে মাটিতে মিশে হারিয়ে যাচ্ছে, সেটা শুধুই আমার ছায়ার উপর হচ্ছে, আমার অস্তিত্বের চারটি মাত্রার উপর হচ্ছে। ‘আসল আমি’ আছি উচ্চতর জগতে, যেখানে আমার আরও কয়েকটি মাত্রা আছে। সেই ‘আসল আমি’র মাত্রায় কিছু পরিবর্তন করলেই হয়ত এই জগতে আমার চতুর্মাত্রিক ছায়া আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে, আমার মৃত দেহ আবার জীবিত হয়ে যায়। —এটা শুধুই একটা সম্ভাবনা, এমন না যে, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, বিজ্ঞান আজকে আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণাকে আমূল পালটে দিয়েছে। আগে আমরা যে ব্যাপারগুলোকে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিতাম, আজকে আমরা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণেই সেগুলোকে পুরোপুরি উড়িয়ে না দিয়ে বিবেচনা করার সুযোগ পাচ্ছি।
যাদের মেনে নিতে কষ্ট হয় যে, তার দেহ যখন অণু পরমাণুতে পরিণত হয়ে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে যাবে, তারপর কীভাবে তাকে আবার হুবহু একইভাবে তৈরি করা সম্ভব এবং কীভাবে তার সমস্ত স্মৃতি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব? —তাদের সমস্যা হচ্ছে তাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনা বস্তু এবং শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে মৌলিক কোনো কিছু মহাবিশ্বে থাকতে পারে, যা তাদের অস্তিত্বকে ধরে রাখতে পারে, তা তাদের পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়।
কীভাবে আল্লাহ تعالى আবারও সবকিছু সৃষ্টি করবেন, সেটাও তিনি বলে দিয়েছেন—
সে তো শুধু একটা বিকট আওয়াজ হবে। অমনি তারা এক খোলা ভূমিতে দাঁড়িয়ে যাবে।
বিকট আওয়াজ — বিগ-ব্যাংগ। ব্যাস, আবার এক নতুন সৃষ্টিজগত তৈরি হয়ে যাবে। মহাবিশ্ব প্রথমবার সৃষ্টি হয়েছিল এক বিগ-ব্যাংগ থেকে। আরেকবার সৃষ্টি হবে আরেক বিগ-ব্যাংগ থেকে। তারপর আমরা দেখবো যে, এক নতুন বিশ্ব জগতে আমরা চলে এসেছি। এক প্রকাণ্ড সমতল ভূমিতে সবাই দাঁড়িয়ে থাকবো।
পুনরুত্থানে অবিশ্বাসীদের একজন ছিল ফিরাউন। এর পরের আয়াতে আল্লাহ تعالى তার ঘটনা আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন—
মুসার ঘটনা শুনেছ? তার প্রতিপালক তাকে পবিত্র উপত্যকা তুয়া-তে ডেকে বলেছিলেন, “ফিরাউনের কাছে যাও, সে সব সীমা পার করে ফেলেছে।” ওকে বোলো, “তুমি কি নিজেকে শোধরাতে চাও? চাও যে, আমি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের দিকে পথ দেখাই, যেন তুমি তাকে ভয় করতে শেখো?” মুসা তাকে দুর্দান্ত অলৌকিক ঘটনা দেখাল। কিন্তু সে অস্বীকার করলো এবং অবাধ্য হলো। তারপর জোরেশোরে তার আগের কাজ করতে লাগল। একসময় সে সবাইকে ডেকে ঘোষণা দিলো, “আমি তোমাদের সর্বোচ্চ প্রতিপালক।” যার ফলে আল্লাহ তাকে আখিরাত এবং দুনিয়াতে কঠিন শাস্তিতে পাকড়াও করলেন। এই ঘটনায় অবশ্যই এক বিরাট শিক্ষা রয়েছে তাদের জন্য, যারা আল্লাহকে শ্রদ্ধা-সম্ভ্রম করে।
তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে আল্লাহ تعالى হাজারো মানুষের চোখের সামনে মেরে ফেলেছিলেন। এটা কোনো গল্প বা লোকেমুখে প্রচলিত কথা নয়। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে ফিরাউনের নজিরবিহীন অত্যাচারের ঘটনা এবং তারই অত্যাচারিত জনগণের চোখের সামনে তার ভরাডুবির ঘটনা। ফিরাউনের দেহকে আল্লাহ تعالى ধ্বংস হয়ে ভুলে যেতে দেননি। সেটাকে তিনি সংরক্ষণ করে রেখেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আজকে মিশরের যাদুঘরে গেলে সেই ফিরাউনের মমি দেখতে পাওয়া যায়।
ফিরাউনের সময়কার মানুষরা ভাবত যে, ফিরাউনকে কিছু করার ক্ষমতা কারো নেই। এমন শক্তিশালী একনায়কতন্ত্র, যেখানে সরকারের একদম উচ্চপদ থেকে শুরু করে নিচু পদের মানুষগুলো সব দুর্নীতিতে ডুবে আছে। যারা দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। গরিব মানুষদের সাথে প্রতারণা করে সব সম্পদ নিজেরা কুক্ষিগত করে ফেলছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এদের হাতের পুতুল। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িত। কোনো আদালত নেই যা কিনা মন্ত্রীপরিষদকে বা সরকার প্রধানকে ধরে শাস্তি দেবে। কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তাকে গুম করে ফেলা হতো, অথবা মেরে ফেলা হতো। —এমন ভয়ংকর এক মাফিয়া সরকারকে পরাজিত করা কোনোভাবে সম্ভব, সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
যারা অত্যাচারিত, তারা ধরেই নিয়েছিল যে, এটাই তাদের নিয়তি। এই সরকারের পরিবর্তন হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। এভাবেই যুগের পর যুগ তারা মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকবে। সেজন্য তারা সরকারের বিরুদ্ধে কোনোকিছু করার উদ্যোগও নিত না। আর সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিশ্চিত ছিল যে, তারা দেশের সবকিছুই এমনভাবে হাত করে ফেলেছে যে, এখন আর তাদেরকে অপসারণ করা কোনোভাবেই সম্ভব না। অপসারণ তো দূরের কথা, তাদেরকে কোনোদিন তাদের কুকর্মের জন্য পস্তাতে হবে, সেটাই তারা কোনোদিন চিন্তা করেনি। তারা নিশ্চিন্তে দিন পার করছিল এই ভেবে যে, তারা এখন সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে, যা খুশি তাই তারা করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ تعالى দেখিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি যখন পরিকল্পনা করেন, তখন দুনিয়ার কারো ক্ষমতা নেই, সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সেই পরিকল্পনার হাত থেকে বাঁচার। তাঁর পরিকল্পনা যখন বাস্তবায়ন হয়, তখন ইতিহাসের অন্যতম দুর্দান্ত প্রতাপশালী, আইনের ঊর্ধ্বে, কারো ধরাছোঁয়ার বাইরে সরকার প্রধানও একসময় বিকৃত মমি হয়ে এক যাদুঘরে মানুষের দেখার জন্য পড়ে থাকে।
[১] বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর। [২] ম্যাসেজ অফ দা কু’রআন — মুহাম্মাদ আসাদ। [৩] তাফহিমুল কু’রআন — মাওলানা মাওদুদি। [৪] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী। [৫] মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran [৬] সৈয়দ কুতব — In the Shade of the Quran [৭] তাদাব্বুরে কু’রআন – আমিন আহসান ইসলাহি। [৮] তাফসিরে তাওযীহুল কু’রআন — মুফতি তাক্বি উসমানী। [৯] বায়ান আল কু’রআন — ড: ইসরার আহমেদ। [১০] তাফসীর উল কু’রআন — মাওলানা আব্দুল মাজিদ দারিয়াবাদি [১১] কু’রআন তাফসীর — আব্দুর রাহিম আস-সারানবি [১২] আত-তাবারি-এর তাফসীরের অনুবাদ। [১৩] তাফসির ইবন আব্বাস। [১৪] তাফসির আল কুরতুবি। [১৫] তাফসির আল জালালাইন। [১৬] লুঘাতুল কুরআন — গুলাম আহমেদ পারভেজ। [১৭] তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব [১৮] কু’রআনুল কারীম – বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর — বাদশাহ ফাহাদ কু’রআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স। [১৯] তাফসির আল-কাবির। [২০] তাফসির আল-কাশ্শাফ।