যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে দুই ভাগ করেছিলাম—বাকারাহ ৫০-৫২

বনি ইসরাইলের এক বিশাল কাফেলা নিয়ে নবী মুসা عليه السلام হেঁটে যাচ্ছেন—তাদেরকে এক নতুন দেশে পৌঁছে দিতে। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে যেতে দিতে রাজি হয়েছে ফিরাউন। কিন্তু এদিকে হঠাৎ ফিরাউন তার মত পাল্টাল: মুসা عليه السلام এর কারণে সে তার রাজত্ব হারিয়ে ফেলেছে—সেই যন্ত্রণায় পুড়ছে সে। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে ফিরাউন ঠিক করল মুসা عليه السلام সহ বনি ইসরাইলদের সবাইকে মেরে ফেলবে। সে তার বাহিনীকে একসাথে জড়ো করে ছুটে গেল তাদেরকে হত্যা করার জন্য।

ওদিকে মুসা عليه السلام তার কাফেলাকে নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে যাচ্ছেন। যেতে যেতে আটকে গেলেন—সামনে এক বিশাল সমুদ্র, এগোবার উপায় নেই আর। পিছনে ফিরে দেখলেন: ফিরাউন তার বাহিনী নিয়ে ছুটে আসছে তাদেরকে হত্যা করার জন্য। বাঁচার কোনো আশা নেই বনি ইসরাইলিদের: সামনে এগোলে সমুদ্রে ডুবে মারা যাবে, আর পেছনে ফিরে গেলে ফিরাউনের বাহিনী তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করবে। দুই দিকেই ভয়ঙ্কর মৃত্যু দেখে বনি ইসরাইলিরা ভয়ে-আতঙ্কে-হতবিহবল হয়ে মুসা عليه السلام এর কাছে ছুটে গেল—কীভাবে বাঁচবে তারা এখন?

musa_parting_sea

আল্লাহর تعالى নির্দেশে মুসা عليه السلام তার হাতের লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত করলেন। সাথে সাথে সমুদ্রের পানি সরে গেল দুই ভাগ হয়ে। সাগরের মাঝে তৈরি হলো শুকনো রাস্তা। সেই পথ দিয়ে  নিরাপদে পার হয়ে গেল বনি ইসরাইলের কাফেলা।

bani_israel_crossing

2_50

যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে দুই ভাগ করেছিলাম, ফিরাউনের হাত থেকে তোমাদেরকে বাঁচাতে; এরপর ফিরাউন ও তার লোকদেরকে আমি ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। তোমরা তো সেটা নিজের চোখেই দেখেছিলে। [বাকারাহ ৫০]

প্রতিশোধের নেশায় উম্মাদ ফিরাউন সিদ্ধান্ত নিল, এই পথ ধরেই এগিয়ে যাবে। যে করেই হোক হত্যা করবে বনি ইসরাইলিদের। তারা যখন মাঝপথে, বনি ইসরাইলিরা তখন পৌঁছে গেছে অন্য পাড়ে। আল্লাহর تعالى  ইচ্ছায় সাগরের পানি দুপাশ থেকে নেমে এল তাদের ওপর। অবিশ্বাস্য এই দৃশ্যটি অন্য পাড়ে দাঁড়িয়ে পুরোটাই নিজের চোখে দেখল বনি ইসরাইলিরা।

تَنظُرُونَ — তারা নিজের চোখে মনোযোগ দিয়ে পুরো ঘটনাটি দেখল। এটা رأى এর মতো পরোক্ষভাবে দেখা, স্বপ্ন দেখা বা উপলব্ধি করা নয়। একদম নিজের চোখে পরিষ্কার ভাবে, মনোযোগ দিয়ে দেখা, যেন কোনো সন্দেহ না থাকে।[৮] তারা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, যেই লোককে তারা খোদা মনে করত, যার বিরুদ্ধে কেউ কোনোদিন কিছু করতে পারেনি, যে তাদেরকে অমানুষের মতো বছরের পর বছর অত্যাচার করেছে: তাদের ছেলে সন্তানদের হত্যা করেছে, মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করেছে— সেই ফিরাউন আজকে তাদের চোখের সামনে সমুদ্রে ডুবে মারা যাচ্ছে। এর চেয়ে আনন্দময় কিছু, শান্তিময় কোনো মুহূর্ত তাদের জীবনে আর ঘটেনি।

আল্লাহ تعالى পুরো ঘটনাটি এমনভাবে পরিকল্পনা করেছেন যেন, ফিরাউনের মারা যাওয়ার ঘটনাটি ঘটে বনি ইসরাইলিদের চোখের সামনেই। কারণ ফিরাউন যদি অন্য কোথাও মারা যেত এবং বনি ইসরাইলিরা কারও কাছে খবর পেত যে, ফিরাউন কোনোভাবে মারা গেছে, তাহলে তারা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারত না। সবসময় তারা আতঙ্কে থাকত যে, ফিরাউনের মতো শক্তিশালী কেউ এত সহজে মারা যাতে পারে না। নিশ্চয়ই সে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে এবং সুযোগ পেলেই তাদের উপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। যেখানেই থাকুক না কেন ফিরাউনের ভয় তাদের তাড়া করে ফিরতই। এরকম যেন না হয়, সেজন্য আল্লাহ تعالى তাদেরই চোখের সামনে ফিরাউনকে ডুবিয়ে দিলেন; তাদের মনে এনে দিলেন প্রশান্তি।

এখানে আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার আছে— ফিরাউনের মতো ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালী, রাজনৈতিক অপরাধীদের শাস্তি হওয়া উচিত প্রকাশ্যে— যারা আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে হাজার হাজার মানুষের সাথে অন্যায় করে। যারা টাকা দিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে কিনে রাখে, তাদেরকে কোনো বন্দি কক্ষে প্রাইভেসির মধ্যে চুপচাপ শাস্তি দিলে হবে না। তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে প্রকাশ্যে, যেন ভুক্তভোগীরা দেখে শান্তি পায়, তাদের আতঙ্কের অবসান ঘটে। সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসির মতো দিনের আলোতে পরিষ্কারভাবে বিবিসি, সিএনএন-এ সবাইকে দেখিয়ে তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে। এর ফলে দুটো উপকার হয়: প্রথমত, যারা এধরনের অপরাধ করে, তারা যখন দেখবে তাদেরই মতো একজন ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এভাবে সবার সামনে শাস্তি পাচ্ছে, তখন ভয়ে তাদের আত্মা শুকিয়ে যাবে। তারা ভালো করে আরেকবার ভেবে দেখবে: তারা যে অন্যায় করছে, সেটা আরও চালিয়ে যাবে? না কি এখন থেকে ভালো হয়ে যাবে? আর দ্বিতীয় উপকার হলো: আইনের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা চলে আসে, মানুষ তখন আইন মেনে চলতে আগ্রহ পায়।

2_51

যখন আমি মুসাকে চল্লিশ রাতের জন্য (সিনাই পর্বতে) রেখেছিলাম (তাওরাত দেবার জন্য), তারপর তোমরা কিনা তার অনুপস্থিতে একটা বাছুরকে পূজা করা শুরু করে দিয়েছিলে! কী জঘন্য অন্যায় করেছিলে তোমরা! [বাকারাহ ৫১]

অকৃতজ্ঞতার চরম কিছু উদাহরণ পাব এখন আমরা। আল্লাহ تعالى বনি ইসরাইলিদেরকে ফিরাউনের জঘন্য অত্যাচার থেকে বাঁচালেন। তারা নিজের চোখেই দেখেছিল সমুদ্রকে দুই ভাগ হয়ে যেতে, ফিরাউনকে ডুবে মরতে। এমনকি তারা একজন নবীকে عليه السلام সশরীরে পেল, যে ইতিহাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে দেখাল। কিন্তু তারপরে যে-ই না মুসা عليه السلام কয়েকদিনের জন্য চলে গেলেন, তারা আবার তাদের মূর্তি পূজায় ডুবে গেল।

এটি একটি অদ্ভুত ঘটনা। পৃথিবীতে কারো যদি আল্লাহর تعالى প্রতি ইস্পাত দৃঢ় ঈমান থাকে, তাহলে সেটা থাকা উচিত ছিল বনি ইসরাইলিদের। লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া, সমুদ্র দুইভাগ হবার মতো এমন সব অলৌকিক ঘটনা যদি কেউ নিজের চোখে দেখে, তাহলে তাদের আল্লাহর تعالى অস্তিত্ব এবং মুসা عليه السلام এর নবী হওয়া নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা না। কিন্তু তারপরেও বনি ইসরাইলইরা মুসা عليه السلام এর অনুপস্থিতিতে সোনার তৈরি এক বাছুরের মূর্তিকে—যা কি না বাতাসে অদ্ভুত শব্দ করত—তাকে তারা দৈব কিছু মনে করে তার পূজা করা শুরু করে দিল! এথেকে বোঝা যায় যে, মানুষকে ভুয়া, অলৌকিক কিছু দেখিয়ে বোকা বনিয়ে শিরক-এ ডুবিয়ে দেওয়া খুবই সহজ, যেটা অনেক পির-দরবেশরা হাজার বছর ধরে ‘যত্নের সাথে’ করে আসছে।

এরকম ঘটনা আজও বনি ইসরাইল টাইপের মুসলিমদের বেলায় ঘটে। যেমন, ধরুন আপনার সন্তানটির জন্ম হলো ডেলিভারির তারিখের দুই মাস আগে। তাকে সাথে সাথে আইসিইউতে রেখে দেওয়া হলো। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলেন। নার্সরা এসে আপনাকে সান্ত্বনা জানাচ্ছে এবং আপনাকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছে। এই অবস্থায় আপনি জীবনে প্রথম বারের মতো জায়নামাজে বসে আল্লাহর تعالى কাছে অনেক কাঁদলেন। তারপর আইসিইউতে ফিরে গিয়ে দেখলেন: ডাক্তাররা ছোটাছুটি করছে— আপনার শিশুটির অবস্থা কোনো এক অদ্ভুত কারণে ভালো হতে শুরু করেছে। আল্লাহর تعالى প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতায়, শ্রদ্ধায় চোখে পানি চলে এল। কয়েক মাস পর আপনি শিশুটিকে সুস্থ অবস্থায় নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেলেন। তারপর প্রতি রাতে সে কান্নাকাটি করে, আপনি তাকে উঠে খাওয়ান। রাতে আর আপনার ঠিকমত ঘুম হয় না। প্রায়ই আপনার ফজরের নামায ছুটে যাওয়া শুরু করল। একসময় বাচ্চা বড় হলো, তার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে আপনার যুহরের নামায প্রায়ই ছুটে যেতে থাকল। শুক্রবারে তাকে কোচিং সেন্টারে দিতে গিয়ে মাঝে মাঝেই আপনার জুম্মার নামায ছুটে যায়। একদিন আপনার বাচ্চার একটা অ্যাকসিডেন্ট হলো। তাকে হাসপাতালে দিয়ে আপনি আবার জায়নামাজে কাঁদা শুরু করলেন। কিন্তু বাচ্চার অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। দিনের পর দিন পার হয়ে যাচ্ছে, আর আপনার বাচ্চার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। একদিন আপনার এক আত্মীয় এসে খবর দিল: মগবাজারের পিরের কাছে যেতে। সে নাকি এরকম অ্যাকসিডেন্টে পড়া অনেক বাচ্চার জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছে। আপনি সাথে সাথে ছুটে গেলেন সেই পিরের কাছে।

এই হলো আজকের যুগের বনি ইসরাইল টাইপের মুসলিমদের শিরকের একটি উদাহরণ।

2_52

এর পরেও আমি তোমাদেরকে মাফ করে দিয়েছিলাম, যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। [বাকারাহ ৫২]

এরকম চরম অন্যায় করার পরেও আল্লাহ تعالى তাদেরকে মাফ করে দিয়েছিলেন। عفو হচ্ছে কোনো ধরনের রাগ চেপে না রেখে, ভালবেসে ক্ষমা করে দেওয়া। যেমন, আপনার বাচ্চা আপনার শখের ল্যাপটপে পানি ঢেলে নষ্ট করে দিল। আপনি অনেক কষ্টে রাগ চেপে একটা শুকনো হাসি দিয়ে তাকে মাফ করে দিলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আপনি ঠিকই গজ গজ করছেন—এটা আ’ফউ নয়। আ’ফউ হচ্ছে আপনি তাকে মাফ করে দিলেন, তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন, সুন্দর করে বোঝালেন—একদম স্বতঃস্ফূর্ত, নির্ভেজাল, কোনো ধরনের দাবি না রেখে মাফ করা।[১]

আল্লাহ تعالى যখন আমাদেরকে মাফ করেন, তিনি আমাদেরকে ভালবেসে, কোনো দাবি না রেখে, পুরোপুরি মাফ করে দেন। মানুষের মধ্যে মানসিক সীমাবদ্ধতা আছে, যে কারণে মানুষ কখনই পুরোপুরি কাউকে মাফ করতে পারে না। বাবা-মাও তাদের সন্তানদেরকে পুরোপুরি মাফ করতে পারেন না—যতই চেষ্টা করেন না কেন, মনের মধ্যে একটা ক্ষোভ থেকেই যায়। এর পরে কখনও ঝগড়া লাগলেই সেই ক্ষোভ বের হয়ে আসে, এবং আগের ঘটনাগুলোর ধারাবর্ণনা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর تعالى এধরনের কোনো মানবিক সীমাবদ্ধতা নেই, তিনি হচ্ছেন আল-আ’ফউ, তিনি যখন কাউকে মাফ করেন, সেটা হয় নিঃশর্তে, সম্পূর্ণ মাফ।

একশ্রেণির মুসলিম ও অমুসলিম ক্রিটিকরা দাবি করে যে, আল্লাহ تعالى হচ্ছেন রাগী, প্রতিশোধপরায়ণ, মাত্রাতিরিক্ত শাস্তি দেয়— এমন এক কঠিন সত্তা। অথচ বাকারাহ-এর এই আয়াতগুলো এবং কু’রআনে ছড়িয়ে থাকা নানা ঘটনা পড়লে দেখা যায়, আল্লাহ تعالى বহুবার মানুষের অনেক বড় বড় অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন, মানুষকে অনেকবার সুযোগ দিয়েছেন যেন তারা নিজেদের শুধরে নেয়। কোনো ধরনের পূর্বধারণা না-রেখে নিরপেক্ষভাবে কেউ যদি কখনও কু’রআন ভালো করে পড়ে, সে দেখবে যে মানুষের প্রতি আল্লাহর تعالى অসীম ধৈর্য, সহনশীলতা, ক্ষমা এবং করুণা দিয়ে ভরে আছে কু’রআন।

সুত্র:

নতুন আর্টিকেল বের হলে জানতে চাইলে কু’রআনের কথা ফেইসবুক পেইজে লাইক করে রাখুন—

9 thoughts on “যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে দুই ভাগ করেছিলাম—বাকারাহ ৫০-৫২”

  1. ধন্যবাদ ।জানা বিষয়ের খুটিনাটি ডিটেইলস আবার জানতে পারলাম । পীরবাদীরা এখন এখানে এসে বকাবকি শুরু না করলেই হয় ।

  2. যথাসম্ভব ৫৩ নং আয়াত দিতে ভুলে গিয়েছেন।

  3. খুব সুন্দরভাবে কোরআনের বিষয়গুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

    ধন্যবাদ

  4. সকল পীর দরবেশ নয়। বলুন ভন্ডদের কথা। কারণ এদেশে ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন পীর-দরবেশ ও মুসলিম ব্যবসায়ীরা। সেই সূত্রে আমরা আজ মুসলিম হিসাবে পরিচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *